Wednesday 1 June 2016

বাংলার লোকসংগীত


লোকসংগীত সংগীত রাজ্যের একটি অন্যতম ধারা। এতি মূলত বাংলার নিজস্ব সংগীত। গ্রাম, বাংলার মানুষের জীবনের কথা, সুখ, দুঃখের কথা ফুটে ওঠে এই সংগীতে। লোকসংগীতের জন্য খুব বেশি যন্ত্রের ব্যবহার করা হয় না ৷ মূলত কথা আর সুরই গানগুলির প্রধান আকর্ষণ ৷

বাংলার লোকগীতিগুলির মধ্যে যে গানগুলির নাম প্রথমেই করতে হয় সেগুলি হল বাউল, গম্ভীরা, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কবিগান, কীর্তন, গাজন, ভাদুগান ইত্যাদি ৷ এছাড়াও, ঝুমুর গান, ঘেঁটু গান, সারি গান, বারোমাসি, মেয়েলি গীত, চোকচুন্দ্রী, ধামগান, ক্ষণগান, চোরচুন্নি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ৷ বাংলার লোকগীতিগুলির অধিকাংশের সঙ্গেই একটা করে মিষ্টি গল্প জড়িয়ে আছে। 

বাউল গান

বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকসংগীত হল বাউলগান ৷ বাউলগানের মূল বিষয়বস্তু প্রকৃতি ৷ এছাড়াও আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, দর্শন, দেহতত্ত্ব ইত্যাদির সংমিশ্রণে সৃষ্ট বাউল গান ৷ এই গানে বৈষ্ণব ও সুফি উভয় সম্প্রদায়ের প্রভাবই লক্ষণীয়। লালন ফকির বাউল গানের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ৷ লালনের গানগুলিকে লালনগীতি বলা হয় ৷ বাউলরা মুখে মুখে গান বাঁধেন ৷ এর কোনও লিখিত রূপ হয় না ৷ মূলত একতারা বাজিয়ে বাউল গান গাওয়া হয় ৷ এছাড়াও দোতারা, খামক, ডুগডুগি, ঢোল, খোল, করতাল, মঞ্জিরা, ঘুঙুরের ব্যবহারও এই গানে হয়ে থাকে ৷ বাউল গানের জুড়ি মেলা ভার ৷ রবীন্দ্র সংগীতেও বাউল গানের প্রভাব যথেষ্ট ৷ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও নদীয়ায় বাউল গানের বিস্তার বেশি হলেও রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই বাউলদের কমবেশি আনাগোনা রয়েছে ৷ শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, কেঁদুলির জয়দেবের মেলা, পাথরচাপুরির দাতাবাবার মেলা, ঝাড়গ্রাম মেলা, পশ্চিম মেদিনীপুরের যুব উৎসব, শক্তিগড়ের মেলা, কল্যাণীর ঘোষপাড়া মেলা ও কলকাতার বাউল-ফকির উৎসবে বাউলগানের আসর বসে ৷ দেশ বিদেশ থেকে বহু মানুষ শুধুমাত্র এই গানের টানে এই মেলাগুলিতে ভিড় জমান ৷

গম্ভীরা

উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে মালদা জেলার অন্যতম জনপ্রিয় লোক সংগীত হল গম্ভীরা ৷ অবশ্য গানের পাশাপাশি এতে নাচের পরিবেশনও হয় ৷ মূলত চৈত্র মাসে চড়ক উৎসবের সময় শিবের মহিমা কীর্তন নাচ ও গানের মাধ্যমে প্রচার করা হয় ৷ প্রাচীন গৌড়িয় জনপদ তৈরির অনেক আগেই গম্ভীরার সৃষ্টি ৷ পণ্ডিতদের মতে গম্ভীরা দু'ধরনের হয় ৷ প্রাথমিক ও Narrative গম্ভীরা ৷ প্রাথমিক গম্ভীরায় দেবদেবীর মহিমা ও মানবজীবনে তার প্রভাব বর্ণিত থাকে ৷ আর মানুষের সামাজিক সমস্যা তুলে ধরা হয় Narrative গম্ভীরায় ৷ একজন বা দুজন শিল্পী গম্ভীরা পরিবেশন করেন ৷ কখনও মুখোশ পরে বিভিন্ন দেবদেবীর সাজে শিল্পীরা গান করে অভিনয় করেন ৷ আবার কখনও দাদু নাতির দুটি কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করে সামাজিক সমস্যা বর্ণনা করে নাচ ও গান পরিবেশন করা হয় ৷ গম্ভীরাতে ঢাকের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ৷ এই গান কিছুটা উচ্চ্স্বরে গাওয়া হয় ৷ গানের সুর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে একই রকম থাকে ৷

ভাদু

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও বীরভূম জেলার জনপ্রিয় লোক সংগীত হল ভাদু ৷ অনাথ শিশুকন্যা ভাদুর জীবনকাহিনি নিয়ে ভাদু উৎসব পালিত হয় ৷ উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ভাদু গান ৷ ভাদুর জীবনকাহিনি নিয়ে তাতে আঞ্চলিক সুর দিয়ে এই গান গাওয়া হয় ৷ সাধারণত গ্রাম বাংলার অবিবাহিত মেয়েরাই এই গান গেয়ে থাকেন ৷

ভাটিয়ালি

ভাটিয়ালি হল মূলত মাঝিদের গান ৷ নদীতে নৌকো বাইতে বাইতে বিশেষ মিষ্টি সুরে মাঝিরা ভাটিয়ালি গান গেয়ে থাকেন ৷ ভাটিয়ালি শব্দটি এসেছে ভাটা থেকে ৷ আবার অন্য মতে, এই গান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাটি অর্থাৎ নদীর নাব্য এলাকায় গাওয়া হত বলে এই গানের আরেক নাম ভাটিয়ালি ৷ এই গানের কথা সাধারণত নৌকা বাওয়া, মাছ ধরা ও নদী সংক্রান্ত হয় ৷ ভাটিয়ালির মূল বিষয়বস্তু প্রকৄতি তত্ত্ব ৷ আব্বাস উদ্দিন, মিরাজ আলি, উকিল মুন্সী, রশিদ উদ্দিন প্রমুখ ব্যক্তি ভাটিয়ালি গায়ক হিসেবে প্রসিদ্ধ ৷ গায়ক আব্বাস উদ্দিনের আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে অতি জনপ্রিয় ভাটিয়ালি গান ৷ ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে ভাটিয়ালি গানের স্বর্ণযুগ বলা হয় ৷

ভাওয়াইয়া

এপার বাংলার কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ও উত্তর দিনাজপুর এবং ওপার বাংলার প্রধানত রংপুর জেলার জনপ্রিয় লোকসংগীত হল ভাওয়াইয়া ৷ এছাডা়ও অসমের ধুবরি ও গোয়ালপাড়াতেও এই গান বহুল প্রচলিত ৷ ভাওয়াইয়া মূলত রাখালদের গান ৷ মাঠে গরু চড়ানোর সময় তারা এই গান গেয়ে থাকে ৷ এই গানের ভাষা সাধারণত রাখালদের কাজ সংক্রান্ত ৷ আর সুর, যেন এক মিঠেকড়া অনুভূতি ৷

কবিগান

মুখে মুখে ছড়া কেটে সুর দিয়ে বিশেষ ভঙ্গীতে কবিগান গাওয়া হয় ৷ কবিগান দুপ্রকার পূর্ববঙ্গীয় ও পশ্চিমবঙ্গীয় ৷ পশ্চিমবঙ্গীয় কবিগান কলকাতার বাবুদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তার লাভ করে ৷ এই ধারায় ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত ছিল ৷ অন্যদিকে পূর্ববঙ্গীয় কবিগান মূলত লোকসংস্কৃতি, লোকাচার, সামাজিকতা ও শিক্ষামূলক বিষয়কে ভিত্তি করে বাঁধা হত ৷ ফলে পূর্ববঙ্গীয় কবিগানের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও পশ্চিমবঙ্গীয় কবিগান আজ প্রায় বিলুপ্ত ৷ বর্তমানে যে কবিগান শোনা যায় সংশোধিত রূপ বলে মনে করা হয় ৷ কবিগান শুরু হয় বন্দনা দিয়ে ৷ সাধারণত দুজন ব্যক্তি বা দলের মধ্যে তর্কের মধ্য দিয়ে কবির লড়াই জমে ওঠে ৷ কবিগান শিখতে হলে দীর্ঘদিনের তালিমের প্রয়োজন ৷ বিভিন ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্রপাঠ, বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা ও কাব্যপ্রতিভার পাশাপাশি শিখতে হয় মঞ্চ উপস্থাপনার কৌশলও ৷ পূ্র্বে ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি কবিয়ালদের মতো শিল্পীরা আসরেই গান বাঁধতেন ৷ আবার অনেক কবিয়াল অন্যকে দিয়ে গান বাঁধাতেন ৷ প্রধান শিল্পীদের সঙ্গে যাঁরা গানে সঙ্গ দিতেন তাঁদের বলা হত দোহার ৷ অনেকে তরজা বা খেউড়ের সঙ্গে কবিগানের তুলনা করলেও আসলে তা এক জিনিস নয় ৷ তরজা বা খেউড়ে ব্যক্তিগত কুৎসা, আক্রমণ বা অশ্লীলতার প্রাধান্য অনেক বেশি ৷ আনুমানিক অষ্টাদশ শতকে কবিগানের উদ্ভব বলে মনে করা হয় ৷ ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি কবিয়াল কবিগানের দিকপাল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

কীর্তন

বাংলায় কীর্তনের প্রচলন হয় মূলত চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে ভক্তি আন্দোলন চলাকালীন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সময় ৷ শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার লীলা, ভগবান ও ভক্তের সম্পর্কই এই গানের প্রধান বিষয়বস্তু ৷ খোল, করতাল সহযোগে কৃষ্ণবন্দনায় মেতে উঠতেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্য ৷

শ্যামাসংগীত

দেবী কালীর আরাধনায় গাওয়া হয় শ্যামাসংগীত ৷ দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় শাক্ত কবিরা শ্যামাসংগীতের প্রচলন করেন ৷ এই সংগীত পূর্ণতা পায় সাধক রামপ্রসাদের হাত ধরে ৷ পরবর্তীকালে কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, রসিকচন্দ্র রায়, রামচন্দ্র, নীলকান্ত মুখোপাধ্যায় সেই ধারা অব্যাহত রাখেন ৷ পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজি নজরুল ইসলামও শ্যামাসংগীত রচনা করেন ৷ শ্যামা সংগীত দুপ্রকারের আধ্যাত্মিক ও পদাবলি (দুর্গাস্তুতি, উমাসংগীত, আগমনী) ৷ দেবী কালীকে মা হিসেবে কল্পনা করে এই গান গাওয়া হয় ৷ ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সময় এই সংগীতের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায় ৷

গাজন

চৈত্রমাসে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় গাজন পরব হয় ৷ গাজন হল ভগবান শিবের মহিমা সংগীত ৷ শিব, পার্বতী সহ বিভিন্ন দেব-দেবীর বেশ ধারণ করে নাচ-গানের মাধ্যমে ভগবানের নাম গান করেন শিল্পীরা ৷ একটা সময় বাংলায় গাজন খুবই জনপ্রিয় থাকলেও বর্তমানে এই লোক সংগীত প্রায় বিলুপ্ত ৷

সারি গান

মাঝি-মাল্লা ও মজুরদের নিজস্ব সৄষ্টি সারিগান ৷ নৌকা প্রতিযোগিতার সময় সাধারণত এই গান গাওয়া হয় ৷ আবার এক নাগাড়ে কাজ করতে করতে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন ৷ ক্লান্তি দূর করতে ও নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য তাঁরা মুখে মুখে গান বাঁধেন ৷ এই গানের কথা ও সুর তাঁদের একান্তই নিজস্ব ৷

ঘেঁটু গান

বাংলাদেশের ময়মনসিং, নেত্রখালি ও কষ্ণগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় লোকসংগীত হল ঘেঁটু গান ৷ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ধারা এই গানের মূল বিষয় ৷ আসরে কোনও বালক বা কিশোরকে মেয়ে সাজিয়ে তার নাকরণ করা হয় ঘেঁটু ৷ ঘেঁটুর সুখ-দুঃখের কথা বর্ণনা করেই গান বাঁধা হয় ৷ সাধারণত শীতকালে এই গানের আসর বসে ৷ আবার বিভিন্ন জায়গায় বর্ষাকালেও এই গান গাওয়া হয় ৷ ঢোল, মঞ্জিরা, খঞ্জনি, বাঁশি, হারমোনিয়াম সহযোগে এই গান গাওয়া হয় ৷ বর্তমানে এই গান প্রায় অবলুপ্তির মুখে ৷

বারোমাসি গান

সারা বছরের সুখ-দুঃখের ঘটনা নিয়ে বাঁধা হয় বারোমাসি গান ৷ বাংলার গ্রামেগঞ্জে এই গান প্রচলিত ৷

মেয়েলি গীত

একান্ত মেয়েলি কথা, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, এমনকি গ্রামের মেয়েদের কান-নাক বিঁধানো নিয়ে মেয়েলি গান বাঁধা হয় ৷ গ্রাম্য মহিলারা একত্রে এই গান করেন ৷

জরি গান

মহরমের সময় ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা যে শোকের গান করেন তা জরি গান নামে পরিচিত ৷

চোকচুন্দ্রী

মূলত দক্ষিণ দিনাজপুর এলাকার নিজস্ব গান ৷ বীজ বপনের সময় কৄষকরা এই গান করে থাকেন ৷

ক্ষণ গান

সমসাময়িক বিষয় নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর এলাকার একান্ত নিজস্ব গান ৷

হালুয়া হালুয়ানি

কৃষকদের গান ৷ গরু-মোষ, চাষের যন্ত্রপাতি কেনা বেচার সময় এই গান গাওয়া হয় ৷

চোরচুন্নি ও ধাম গান

জলপাইগুড়ির জনপ্রিয় দুটি লোকগীতি হল চোরচুন্নি ও ধামগান ৷ নানা কাল্পনিক, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক চরিত্র এই গানগুলির কেন্দ্রীয় বিষয় ৷

গীতিকা

গীতিকার আরেক নাম গীতিনাট্য ৷ গীতিকা দুপ্রকারের ৷ পূর্ববঙ্গীয় গীতিকা ও নাথ গীতিকা ৷ পূর্ববঙ্গীয় গীতিকা মূলত ময়মনসিংহ জেলার গীতিনাট্য ৷ মহুয়া, মালুয়া, চন্দ্রাবতী, দেওয়ান মদিনা, কঙ্তা ও লীলা, কমলা, দেওয়ান ভাবনা ইত্যাদি পূর্ববঙ্গীয় গীতিকার অন্তর্গত ৷ রাজা গোপীচন্দ্রের বিভিন্ন কথোপকথন গীতিনাট্যের আকারে সুরারোপিত হয়ে গীতিকা গড়ে উঠেছে ৷ মাণিকচন্দ্র রাজারা গান, গোবিন্দচন্দ্রের গীত, ময়নামতির গান, গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস, গোপীচন্দ্রের পাঁচালী ইত্যাদি নিয়ে রচিত হয়েছে গীতিকা ৷

সূত্রঃ এইদুনিয়া ইন্ডিয়া।

0 comments