Wednesday 1 June 2016

বাংলার লোকনৃত্য


নৃত্য বা নৃত্যকলার ইংরেজি প্রতিশব্দ Dance এসেছে প্রাচীন ফ্রেঞ্চ শব্দ Dancier থেকে, যা মূলত শারীরিক নড়াচড়ার প্রকাশভঙ্গীকে বোঝায়। নাচ বা নৃত্য হলো দৈহিক প্রতিভঙ্গিমা, তবে তা প্রতিদিনের ব্যবহার জীবনের প্রতিভঙ্গিমা নয়। এ প্রকাশভঙ্গী সামাজিক, ধর্মীয় বা মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এতে আছে গতি, মুদ্রা, সংযম ও ছন্দ।

নৃত্যকলা শিল্পের এমন একটি শাখা, যা খুব সম্ভবত প্রাচীনতম। প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন হিসেবে নানা বস্তু পাওয়া গেলেও নৃত্যের তেমন কিছু পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীন জনপদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে নাচ প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মিশরীয় দেয়ালচিত্রে ও ভারতীয় গুহাচিতে নৃত্যকলার বিভিন্ন ভঙ্গী দেখতে পাওয়া যায়। নৃত্যকলার ব্যবহার যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে নাচের এই ব্যবহার ব্রাজিলীয় সংস্কৃতি থেকে শুরু করে ভারতীয় সংস্কৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত। লোকসংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়া এই নৃত্যকলাই হচ্ছে লোকনৃত্য। লোকনৃত্য নৃত্যকলার অন্তর্ভুক্ত হলেও কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে তা শাস্ত্রীয় বা ক্লাসিক নৃত্য থেকে কিছুটা আলাদা। লোকনৃত্য ছন্দের কঠোর নীতি খুব একটা অনুসরণ করে না। ক্লাসিক নৃত্যের তুলনায় লোকনৃত্যে সংযম ও ছন্দের অভাব রয়েছে, কারণ এতে মুদ্রার ব্যবহার খুব একটা নেই। লোকনৃত্যের গতি, ছন্দ, অঙ্গকৌশল অনেকটা বাস্তব জীবনের কাছাকাছি।


শাস্ত্রীয় নৃত্যের ক্ষেত্রে পোশাক ও সাজসজ্জা একটি অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু লোকনৃত্যের ক্ষেত্রে পোশাক তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। লোকনৃত্য সাধারণত দলবদ্ধভাবে পরিবেশিত হয়। কারণ জীবনচক্রের গতিময় দলবদ্ধ আচরণই লোকনৃত্য বা পল্লীনৃত্যের অনুপ্রেরণা। লোকনৃত্যের বৈচিত্রেও বাংলা একইভাবে সমৃদ্ধ ৷ ছৌ নাচ, ঝুমুর, ব্রিতা, টুসু, নাচনি, ইত্যাদি বাংলার বিখ্যাত লোকনৃত্য ৷

ছৌ নাচ

পুরুলিয়া জেলার ছৌ নাচের খ্যাতি বাংলা তো বটেই এমনকি দেশের গন্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশেও ৷ মুখোশ ও রং-বেরঙের পোষাক পরে ছৌ শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেন ৷ অন্য নাচের থেকে ছৌ-এর শিল্পকলা একেবারে আলাদা ৷ এই নাচের ভঙ্গি মার্শাল আর্টকে মনে করিয়ে দেয়। ছৌ নাচের বেশ কিছু নিজস্ব ভঙ্গি রয়েছে ৷ যেমন- দানব চাল (দানব বা রাক্ষসের নৃত্য), দেব চাল (দেব-দেবীদের মতো নৃত্য), পশু চাল (পশুর মতো নৃত্য), বাঘচাল (বাঘের মতো নৃত্য), ময়ূর চাল, হরিণচাল, ইত্যাদি ৷

রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি জনপ্রিয় পৌরানিক কাহিনি ছৌ নাচের প্রধান বিষয়বস্তু ৷ আদিবাসীদের শুভ অনুষ্ঠান, বিবাহ, বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনা, বর্ষার আহ্বান প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছৌ নাচ পরিবেশন করা হয় ৷ সন্ধেবেলায় এই নাচের আসর বসে ৷ রাত যত বাড়ে আসর তত জমে ওঠে ৷ এই নাচের শিল্পীদের শিল্পসত্তার পাশাপাশি শারীরিক শক্তিও থাকা প্রয়োজন ৷ সংস্কৃত ছায়া থেকে ছৌ কথাটি এসেছে বলে অনেকে মনে করেন ৷ যদিও বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে ৷ ছৌ শিল্পের স্রষ্টা পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়া ৷ তাঁর বাড়ি পুরুলিয়া বাঘমুন্ডার মুখোশ গ্রাম নামে পরিচিত চড়িদা গ্রামে ৷

ঝুমুর নাচ

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান ও মেদিনীপুর অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় নাচ ও গান হল ঝুমুর ৷ অসমের আদিবাসীদের মধ্যেও এই নাচের প্রচলন রয়েছে ৷ অল্পবয়সী মেয়েরা পায়ে ঝুমুর পরে দল বেঁধে নাচ করে ৷ ছেলেরা মাদল, বাঁশি ও বয় করতাল বাজিয়ে গানে তাল দেয় ৷ মেয়েরা একে অপরের কোমর ধরে সেই গান বাজনার তালে তালে নাচ করে ৷ কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বর্ষার আহ্বান বা কোনও শুভ কাজের সময় ঝুমুর নাচ-গান করা হয়ে থাকে ৷ ঝুমুর গানের ভাষায় সাধারণত দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সুখ-দুঃখ ইত্যাদির প্রভাব থাকে ৷

ব্রিতা নাচ

বাংলার গ্রামগঞ্জের সন্তানহীন মহিলারা বহুদিন পর সন্তান লাভের পর দেবদেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে দল বেঁধে ব্রিতা নাচ করেন ৷ আবার গুটিবসন্ত ইত্যাদি রোগের থেকে পরিবারের লোকজন সুস্থ হলেও মহিলারা এই নাচ করে থাকেন ৷ গ্রামে মহিলারাই শুধুমাত্র এই নাচে অংশগ্রহণ করতে পারেন ৷

টুসু নাচ

বীরভূম, পুরুলিয়া, মেদিনীপুরের আদিবাসী সম্প্রদায়ের টুসু পরবে এই নাচ হয়ে থাকে ৷ মকর সংক্রান্তি সময় টুসু পরব হয় ৷ পৌষ মাসের বিকেল বেলায় ধর্মীয় রীতি মেনে গ্রামের অল্পবয়সী মেয়েরা দল বেঁধে টুসু নাচ নেচে থাকে ৷ আসলে ফসল ফলানোর কৃতজ্ঞতায় আদিবাসীরা তাদের ভগবান টুসুর মূর্তি গড়ে পুজো করে থাকে ৷ এই পরবের নামই টুসু পরব ৷ আর এই পরবে যে নাচ গান হয় তা টুসু নাচ বা গান নামে পরিচিত ৷

নাচনি

নাচনি নৃত্যের উৎপত্তি পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি এলাকায় ৷ স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী, ছোট ছোট মেয়েদের নাচের গুরুর কাছে বেচে দেওয়া হয় ৷ তাদের প্রশিক্ষণ দিতে নৃত্য শিল্পী তৈরি করেন নাচের গুরুরা ৷ ওই সমস্ত গ্রাম্য নৃত্য শিল্পীদের বলা হয় নাচনি ৷ তাদের নাচকে বলে নাচনি নৃত্য ৷ গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই নাচ হয়ে থাকে ৷

রায়বেঁশে নাচ

কোচবিহার, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বীরভূম জেলার জনপ্রিয় নাচ হল রায়বেঁশে ৷ এই নাচ পুরুষরা পরিবেশন করে থাকেন ৷ একটি বড় বাঁশ নিয়ে বিভিন্ন রকমভঙ্গিতে এই নৃত্য করা হয়ে থাকে ৷ নাচের সময় শিল্পীরা তির ছোড়া, বর্শা ছোড়া ও তলোয়ার খেলার অভিনয় করে থাকেন ৷ শিল্পীদের ডান পায়ে ঘুঙুর পরা থাকে ৷ ঢোল ও কাঁসির তালে এই নাচ নাচেন শিল্পীরা।

সাঁওতালি নৃত্য

ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সাঁওতালরা অন্যতম ৷ পশ্চিমবঙ্গে ও ঝাড়খণ্ডে সবথেকে বেশি সাঁওতাল বসবাস করেন ৷সাঁওতালদের নাচ অন্যান্য নাচের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ৷ এদের নিজস্ব সংগীত রয়েছে ৷ চাঁদনী রাতে মাদল বাজিয়ে, সাঁওতালি নাচের আনন্দ উপভোগ করার অনুভূতিই আলাদা ৷ 

লাঠি নাচ

বাংলা লোকনৃত্যের এক উল্লেখযোগ্য নাচ হল লাঠি নাচ ৷ মহরমের সময় ১০দিন ধরে এই লাঠি নাচ হয়ে থাকে ৷ মূলত লাঠি নিয়ে এই নাচ করা হয় বলে এর নাম লাঠি নাচ ৷ এই নাচে রাগ, দুঃখ, ব্যথা, কষ্ট, ভালোবাসা সব ধরনের মনোভাব খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয় ৷ মহরমের সময় অল্পবয়সী ছেলেরা দল বেঁধে এই নাচ পরিবেশন করে ৷

খ্যামটা নাচ

আজ থেকে প্রায় কয়েক দশক আগেও খ্যামটা নাচ বাংলায় জনপ্রিয় ছিল ৷ মহিলা নৃত্যশিল্পীরা দল বেঁধে এই নৃত্য পরিবেশন করতেন ৷ জমিদার বাড়ির অনুষ্ঠান, বারোয়ারি অনুষ্ঠান, দুর্গাপুজো, দোল প্রভৃতি উৎসবে খ্যামটা নাচের চাহিদা ছিল ব্যাপক ৷ রাধা-কৃষ্ণের লীলা ও বিভিন্ন সামাজিক বিষয় ছিল খ্যামটা নাচের অঙ্গ ৷

করম নাচ

করম নাচ হল ফসল কাটার নাচ ৷ গ্রাম বাংলায় ফসল কাটার আগে মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে এই নাচ করে থাকেন ৷ মহিলা ও পুরুষদের দুটি আলাদা দল থাকে ৷ পুরুষদের মধ্যে একজন প্রধান থাকেন ৷ তাঁর হাতে একটি বড় তাল পাতার হাতপাখা থাকে ৷ তিনি সেটি দিয়ে পাকা ফসলে হাওয়া দিতে থাকেন ৷ ফসল পাকার আনন্দে সকলে নৃত্য করেন ৷ এই নাচ সাধারণত মঞ্চে বা কোনও অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয় ৷

কাঠি নাচ

কাঠি নাচ প্রকৃতপক্ষে রণপা নাচ ৷ রণপার ওপর দাঁড়িয়ে পুরুষশিল্পীরা এই নাচ পরিবেশন করেন ৷ এই নাচ যথেষ্ট বিপজ্জনক ৷ এর জন্য দীর্ঘদিনের অনুশীলন প্রয়োজন ৷

বাংলার লোকনাট্য

যাত্রাপালা, পুতুল নাটিকা, পালাগান ইত্যাদি বাংলার লোকনাট্যের অন্তর্গত ৷

যাত্রা

বাংলা লোকনাট্যের প্রধান হল যাত্রা ৷ সংলাপ, নাচ, গান, অভিনয় সবকিছুর সংমিশ্রণ হল যাত্রা ৷ পূর্বে পৌরাণিক কাহিনি, আধ্যাত্মিক কাহিনির মাধ্যমে জনজাগরণ, সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যাত্রার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য ৷ আনুমানিক ষষ্ঠদশ শতকে ভক্তি আন্দোলনের সময় উৎপত্তি হয় যাত্রার ৷ প্রথম প্রথম শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা নিয়ে যাত্রা রচিত হত ৷ জয় দেবের গীতগোবিন্দ, চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যাত্রার সৃষ্টি ৷ পরবর্তীকালে রামায়ণ, মহাভারত সহ পুরাণ, মহাকাব্য, ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুও যাত্রার অন্তর্ভুক্ত হয়েছ ৷ তারও পরে যাত্রার সামাজিক বিষয়, রাজনীতি ইত্যাদির প্রবেশও ঘটেছে ৷

পুতুলনাটিকা বা পুতুল নাচ

বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ হল পুতুল নাটিকা বা পুতুল নাচ ৷ সাধারণত কাঠ দিয়ে তৈরি পুতুলগুলিকে বিশেষ পদ্ধতিতে সুতো বা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বাঁধা হয় ৷ রঙিন কাপড় ও সাজপোশাক পরিয়ে পুতুলগুলিকে সাজানো হয় ৷ পুতুলের পা থাকে না, পরিবর্তে বাঁশের কঞ্চির কাঠামো থাকে ৷ পর্দার বাইরে থেকে শিল্পীরা পুতুলে বাঁধা দড়ি বা কঞ্চি টেনে নানা পদ্ধতিতে সেগুলিকে নাড়ান ৷ বাচিক শিল্পীদের সংলাপ ও গান এবং তার সঙ্গে পুতুল শিল্পীদের কারুকার্যে নাটক জমে ওঠে ৷ মূলত ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, সামাজিক গল্প নিয়েই পুতুল নাটক লেখা হত ৷ বর্তমানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নাটকের পটভূমিরও যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে ৷

পালাগান

পালাগান অনেকটা গীতি নাট্যের মতো ৷ কোনও ঘটনা বা গল্পকে সুর দিয়ে গানের আকারে প্রকাশ করাই হল পালাগান ৷ ধর্মীয়, সামাজিক, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পালাগান লেখা হত ৷

বিষহরা পালা

জলপাইগুড়ি জেলার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান এই বিষহরা পালা ৷ মূলত মনসা মঙ্গল কাব্যকে নাটকের আকারে মঞ্চস্থ করা হয় ৷ চাঁদ সদাগর, বেহুলা-লখিন্দর, দেবী মনসা, প্রভৃতি চরিত্রগুলি বিষহরা পালার মূল আকর্ষণ ৷

আলকাপ

নাচ, গান, নাটকের সংমিশ্রণ আলকাপ মুর্শিদাবাদ, মালদা, বীরভূম এবং বাংলাদেশের রাজশাহীতে বেশ জনপ্রিয় ৷ বিহারের দুমকা ও পূর্ণিয়া এবং ঝাড়খণ্ডেও এই আলকাপের প্রচলন রয়েছে ৷ আল কথার অর্থ কাব্যাংশ ৷ আর কাপ কথাটি এসেছে কাব্য থেকে ৷ ১০-১২ জনের একটি দল আলকাপ পরিবেশন করে ৷ দলের প্রধানকে বলা হয় সরকার বা গুরু ৷ আলকাপ ৫টি পর্বে পরিবেশিত হয় ৷ এগুলি হল আসর বন্দনা, ছড়া, কাপ, বৈঠকি গান ও খ্যামটা পালা ৷ গ্রাম্য সামাজিক বিষয় আলকাপের মূল প্রেক্ষপট ৷

ডোমনি

মালদা জেলার জনপ্রিয় লোকনাট্য ডোমনি ৷ নিতান্তই পাড়া গেঁয়ে নাটক ৷ গরিব মানুষের দৈনন্দিন বিষয় এই লোকনাট্যের মূল বিষয়বস্তু ৷






0 comments