Wednesday 1 June 2016

ছৌ নৃত্য –এক মেলবন্ধন


মন কাড়া, আকর্ষণীয়। বিভিন্ন পৌরানিক চরিত্র অনুসরনে তৈরি মুখ। কাগজের মণ্ড দিয়ে ছাঁচে ঢেলে মুখের আদল দেয়া হয়। তারপর মুকুট, চুমকি বসিয়ে সেটাকে উঙ্কÄল রূপ দেয়া হয়। নিঃসন্দেহে শহুরে বসার ঘরের সৌন্দর্য অনেক খানি বাড়িয়ে তোলে আর তাতে গৃহকর্ত্তী  বা কর্তার রুচির একটি পরিচিতি হয় বইকি। পুজোর পরে যে মেলার সমাহার ঘটে তাতে ছৌ নাচ ও মুখোশের কদর ও খুব বেশি হয়। লোক সংস্কৃতির আদর বা পুনর্জাগরন গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আবার যেন নিজের সংস্কৃতি, সুর, কলা- কে পেছন ফিরে দেখার আয়োজন শুরু হয়েছে।অএক দিকে যেমন বিশ্বায়ন থাবা বসাচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্মের ওপর তেমনি নিজেদের সংস্কৃতির পুনর্জাগরন ঘটানোরও একটা চেষ্টা চলছে।

ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্য ও পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা সাতশপাহাড় ,টিলা ও গহীন ,গভীর জঙ্গলের দেশ। প্রকৃতির আশ্চর্য মোহময়তা সমস্ত স্থানটিতে ছড়িয়ে আছে যার ছাপ স্থানীয় মানুষের ওপর স্পষ্ট । পাহাড়ের সবুজ সৌন্দর্য ,ঝিলমিল ঝর্ণা, নুড়িবিছান নদীর আঁচল , ঘন জঙ্গলের লাল মাটি ,কাল মানুষ ,খারকি নদির পারে পুরান জাগন্নাথ মন্দির, ধামসা মাদলের সঙ্গে লোকনৃত্য, প্রাত্যহিক সুখ দুঃখ- এ সকল নিয়ে পাহাড়ি জীবন। এখানে তাদের আপন জগত ,আপন ভাবের বাসা । আদিকাল থেকে স্থানীয় মানুষেরা একেবারে নিজস্ব পরিচিতি, নিজস্ব ধারাকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। থেকেছেন সব সময় স্বাধীন। বহিঃশত্রু সাহস করেনি এ পথে পা বাড়াবার। নিজেদের সভ্যতা সংস্কৃতি নিয়ে তারা তাদের মত বাঁচতেন। যদিও দেশজ রাজরাজড়া দের অধীনে ছিল এই স্থানগুলো। আশেপাশের প্রতিবেশী দের সঙ্গে হামেশাই লেগে থাকত খুনসুটি ,ঝগড়া,ফলত যুদ্ধ। গড়ে উঠেছিল কেল্লা ও গড়। অন্তঃশত্রুর থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য জনগণকে প্রশিক্ষন দেয়া হত এগুলোর ভেতরে। চলত ঢাল ,তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধের মহড়া । এই যুদ্ধ মহড়ার অপরিহার্য অঙ্গ ছিল শরীর মজবুত রাখা। এ ছাড়াও ব্রিটিশদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে উন্নততর অস্ত্রের আগমনে ঢাল তরোয়াল তার মাহাত্ম্য হারাল। তাই প্রবর্তন করা হল ‘ ফারিখান্দা ’ বা যুদ্ধ নৃত্যের । যুদ্ধের সকল কলা কৌশল কে অবলম্বন করে ছৌ এর জন্ম হল। যুদ্ধের মহড়া দিতে দিতে শরীর কে সুনিবদ্ধ রাখার কাজ টি ও যে করতে হয়। তাই নাচ।অপরে অনেক উপনদী এতে এসে মিলিত হয় । যেমন আচার্য ভরতের ‘ নাট্যশাস্ত্রের ’অনেক উপাদান এসে যুক্ত হয়। শাস্ত্রীয় ও লোকনৃত্যের ভাব সন্মেলনে গড়ে ওঠে এক অপূর্ব নৃত্য শৈলী আজ যা দেশে বিদেশে আদৃত । সারাইকেলা(ঝারখণ্ড), ময়ূর ভঞ্জ (উড়িষ্যা), পুরুলিয়া( পশ্চিমবঙ্গ) ঘরানার মধ্যে অনেক বিভিন্নতা ও বৈচিত্র রয়েছে। যদিও সারাইকেলাকে ছৌ নাচের জন্মভুমি ধরা হয়। সরাইকেলা,ময়ূরভঞ্জ,পুরুলিয়া কে ঘিরেই ছৌ নাচের জন্ম,প্রশার ও বেড়ে ওঠা।

ছৌ শব্দটির উৎস নিয়ে ও বিভিন্ন রকম মতভেদ আছে। তবু ও ধরা হয় ছৌ অর্থ ছায়া বা মুখোশ ; কারও মতে ‘ ছাউনি ’ - সৈন্যদের ছাউনি থেকে ছৌ শব্দের উৎপত্তি।

বসন্ত কাল যা ভারতীয় সময় পঞ্জীকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। পুরান বছরকে বিদায় ও নতুন বছরের আগমন এই সময়েই ঘটে। তাই প্রত্যেকটি রাজ্যে চৈত্র পরব বা বসন্ত উৎসব নতুন জোয়ার নিয়ে আসে।অ।অতারই প্রকাশ ঘটে চৈত্র বৈশাখের বিভিন্ন আনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। সরাইকেলা ও ময়ূরভঞ্জে চৈত্র পরবের আগমনে ছৌ-নাচের জমজমাট আসর বসে। আবাল বৃদ্ধ বনিতা, সমাজের সর্বক্ষেত্রের মানুষের আনন্দের উৎস হয়ে ওঠে এই নাচ। ‘

চৈত্র পরব ’ কেবলমাত্র একটি উৎসব নয় এই আদিবাসী অঞ্চলের ঐতিহ্যও বটে। চৈত্রের শিবের বন্দনা আমরা চড়কেও দেখি । আদিবাসী অঞ্চলে ও বসন্ত উৎসবের অবশ্যম্বাভি আড়ম্বর হিসেবে ছৌ ছিল অন্যতম আকর্ষণ । সারারাত ধরে চলে নৃত্য অনুষ্ঠান চলে শিবের আরাধনা। আস্তে আস্তে এই নাচ ধর্মীয় ভাব থেকে সম্পূর্ণ একটি সস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। আনন্দে মাতরা হয় রাঙ্গা মাটি ,নীল পাহাড়ির দেশের মানুষ । রাজার উন্মুক্ত চাতালে বসত ছৌ-এর আসর । জনগনের জন্য রাজার উঠান থাকতো অবারিত। নৃত্যের শুরু থেকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হত। প্রথম পর্বটি হত ‘ ছালি ’ , অথবা একটি পশুর আচার আচরণ নকল করে হাত,পা ,মাথা ও ঘাড়ের তড়িৎ চালনার মাধ্যমে। তার সঙ্গে পায়ের ও যথেষ্ট কলা কৌশল প্রদর্শিত হত । যে জন্য নৃত্য ব্যাকরনটিকে উপেক্ষা করা যেত না । যথেষ্ঠ কসরত করে আয়ত্ব করতে হত নাচের কলা কৌশল। দ্বিতীয় পর্যায় টি হল –‘উপালয় ’ বা ‘ উপাহেলি ’ -যা হল নৃত্যের মূল আত্মা । এই পর্বটি থেকে শাস্ত্রীয় ভাবের প্রবেশ ঘটে । সূক্ষ্ম আকার প্রকরন মধ্যে দিয়ে নাচটিকে তুলে ধরা হয়। ছৌ আসলে এক পুরুষালি যুদ্ধ নৃত্য। ছালি বা উপালয়ের মধ্যে দিয়ে শিল্পী ‘ খেল ’ বা তরবারি অনুশিলনের দিকে এগোতে থাকেন। খেল বা অস্ত্র চালনা শরীরের অভূতপূর্ব শক্তি ও ক্ষিপ্রতা দাবি করে। যেহেতু নাচটি মুখোশের অন্তরালে থেকে করতে হয় তাই মুখের ভাব প্রকাশ করার অবকাশ থাকে না। সুতরাং মুখ, ঘাড় ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গের ব্যাবহার এখানে বিশেষ ভুমিকা নেয়। নৃত্যের সংগে সংগীতের একটি আয়োজন থাকে-সানাই , ঢোল, শিঙ্গা, মন্দিরা, বাঁশী ইত্যাদি সহযোগে একটি সংগীতের আবহ তৈরী করা হয়। আজকাল বেহালা, হারমোনিয়ম, সেতারও ব্যবহার করা হয়। ভারতীয় সংগীত শাস্ত্রে তাল, লয়, ছন্দের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ছৌ নাচের ক্ষেত্রেও তাল,  লয়, ছন্দের বিশেষ প্রয়োগ ঘটেছে। ছৌ নৃত্যশিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনার সময় গুরু নিকটে বসে তালমাত্রা উচ্চারন করেন। নৃত্যের তাল সেই উচ্চারিত তালকে অনুসরন করে পরিবেশিত হয়।

আচার্য ভরতচন্দ্রের ‘ নাট্যশাস্ত্রের ’ নীতি,নিয়ম শৃঙ্খলা অবলম্বন করে শাস্ত্রীয় নৃত্যের রূপ পরিগ্রহ করেছে ছৌ। আমরা যে একে আদিবাসী নৃত্য বা লোকনৃত্য বলি তাতে এর গাম্ভীর্য ভাবসৌন্দর্য কে অবহেলা করা হয় বলে কেউ কেউ মনে করেন। এটা সত্যি যে এর উৎপত্তি আদিবাসী অধ্যুসিত অঞ্চলে ও পর্যায়ক্রমে অগ্রগতি ঐ অঞ্চলকে ঘিরেই । তবুও ছৌ নামের মাহাত্ম্য ও বৈশিষ্ঠ্য হল শাস্ত্রীয় ও লোক নৃত্যের ভাব সন্মেলন । যা ছৌ নাচকে অন্য মাত্রা দিয়েছে এবং অনন্যতা তৈরি করেছে। নৃত্যের অঙ্গনে শৈলীকে আমরা দুটি ভাগ হিসেবে জানি- একটি শুদ্ধ শাস্ত্রীয় বা লোকনৃত্য এবং আরও অন্যান্য ধারা । কিন্তু শাস্ত্রীয় শৃঙ্খলায় লোকভাবের আঙ্গিকে বা ভাবনায় গড়ে উঠে নিজস্ব পরিচিতি লাভ করেছে। সেটা একমাত্র ছৌ -এর ক্ষেত্রে দেখা যায় ।

অবশ্যই ছৌ নাচ সরাইকেলার রাজারাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় জীবনের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা এক যুদ্ধনৃত্যের প্রতিরূপ। কিন্তু ‘ নাট্যশাস্ত্র ’ বর্ণিত ‘ নৃত্য ’বা ’ তাণ্ডবের ’ বৈশিষ্ঠ্য এর মধ্যে স্পস্ট। এর গতিময়তা ও সম্প্রসারন বিভিন্ন সময় ঘটেছে । সুতরাং ছৌ নাচ হঠাৎ করে শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীর অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ‘ তাণ্ডব ’ ধারার অনুষঙ্গ হিসেবে নাকাড়া,ঢোল, পাখোয়াজ,ধামসা ইত্যাদি সংগীত যন্ত্রের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে তাণ্ডবের ভাবের উচ্চকিত শব্দ সৃষ্টি করা হত নাচের প্রয়োজনে।  শাস্ত্রীয় ও লোকধারার মেলবন্ধন ও তার মূল উৎপত্তিস্থল সরাইকেলার থেকে ময়ূরভঞ্জ ও পুরুলিয়ার মধ্যে বিভিন্ন রূপ গ্রহন -ও গ্রহন বর্জনের মধ্যে দিয়ে নতুন ধারা তৈরি করেছে। সুতরাং ছৌ-নাচ ‘ ফারিখান্দা ’ র(তরোয়াল ও ঢালের লোকনৃত্য) লোককলা থেকে শাস্ত্রীয় নৃত্যের এক দীর্ঘ যাত্রা বলা যায়।

অহর্যাভিনয় ’ ছৌ নাচের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। ভরত আচার্যের মতে পোশাক ও গহনা নৃত্যের বিশেষ অঙ্গ। মুখোশ ,পোশাক, গহনা ,অস্ত্র, সঙ্গীত, যন্ত্রানুসঙ্গ -এই প্রকরণগুলো নৃত্যশাস্ত্রে বিশেষ ভাবে বর্ণিত হয়েছে। সঙ্গীত যন্ত্রানুসঙ্গ, ‘ তাল-লয়-ছন্দের ’ ব্যাবহার ছৌ নাচ কে শাস্ত্রীয় নৃত্যের উৎকর্ষতা দিয়েছে। যুদ্ধ নৃত্য যখন বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে শাস্ত্রীয় নৃত্যের রূপ পেতে শুরু করেছে তখন থেকে রামায়ন ,মহাভারত ,পুরান, ও সংস্কৃত সাহিত্যের মহাকাব্য কাহিনীর প্রেম, বিরহ প্রভৃতি মানবিক অনুভূতি গুলিকে নৃত্যের বিষয় হিসেবে গ্রহন করে। আবার সমাজ জীবনের কথা,দেশপ্রেম,সামজিক সমস্যা,ঐতিহাসিক ঘটনা,প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,কৃষিজীবনের কথা ইত্যাদি লৌকিক বিষয়ও এসেছে।
যদিও ‘ নাট্যশাস্ত্রের ’ রস ভাবের কথা বলা হয় তবে ছৌ নাচে ‘ বীররসের ’ প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি। ‘ 

শৃঙ্গাররস ’ বা প্রেম ভাব পরে এসেছে। যুদ্ধের কলা কৌশলের চর্চা করেই এর অগ্রগতি। বীররস ও শৃঙ্গার রসের মিলন সরাইকেলা ও ময়ুরভঞ্জ ছৌ নাচে দেখা যায়। সরাইকেলা ছৌ নাচে সুক্ষতা ও গাম্ভীর্য অনেক বেশী। ছৌ নাচে নাটকের মত কথোপকথন বা সঙ্গীত না থাকায় হস্তমুদ্রা, পদক্ষেপ ,শরীরী বিভঙ্গময়তা ,ভাষা ও কথোপকথনের বা তার বিষয় বোঝাবার মাধ্যম হয়ে ওঠে । মনের ভাব প্রকাশের মূল ভূমিকা শরীরী প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঘটে ।অরাগ প্রকাশের সময় শরীরের ক্ষিপ্রতা ,দৃঢ়তা ;বীরভাব প্রকাশের সময় শরীরে কঠিন ভাষা ; মনের পেলবতা প্রকাশের সময় শরীরের ভাব ও হয় নরম, স্থির ,ধীর। সেইজন্য একটি ধারা ‘ তাণ্ডব ’ আর একটি ধারা ‘ লাস্য ’ । আবার এর যে লোক উপাদান সেটি সম্পূর্ণ লোককথার ,লোকজীবনের যে অঙ্গচালনা তার থকে গ্রহন করা- যেমন পশুপাখির আচার আচরণ নকল করে নিজের মত করে প্রতিফলন ঘটান। ক্রমাগত লোকজীবনের প্রতিচ্ছবি এই নাচকে কঠোর শাস্ত্রীয় নাচের তথাকথিত শৃঙ্খলা থকে মুক্তি দিয়েছে তাই সাধারণ মানুষের কাছে বেশী গ্রহন যোগ্য হয়েছে।

সমাজের সকল শ্রেনীর মানুষকে বিনি সুতোয় গেথেছে ছৌ নাচ। নৃত্যশিল্পীরা সকল শ্রেণী থেকে এসে যোগদান করেন। জাতি বর্ন, সম্প্রদায়, একসাথে এই নাচের সাথে তাল মেলায় । নাচটি কিন্তু উচ্চবর্ণ ও আদিবাসী জনজাতিরাই শুরু করে। বিষয়বস্তু ও তার প্রকার প্রকরন পৌরাণিক কাহিনিও লোকগাথার সংমিশ্রনে তৈরি । যা কিনা সমস্ত নাচকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তুলেছে। এই আঞ্চলিক চরিত্র ,মানুষ ও তাদের পোশাক পরিচ্ছদ ,ঋতুর পদচারনা – সমস্ত কিছুই এই ঐতিহ্যকে, পুরানো কলাকে সমৃদ্ধ করেছে। সারা পৃথিবীর কাছে ছৌ নাচ সম্মানের সঙ্গে আদৃত।

[ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]

0 comments