Friday 13 May 2016

পদাবলী সাহিত্য - বৈষ্ণব পদাবলী


কবি জ্ঞানদাস (শ্রীমঙ্গল, মঙ্গল ঠাকুর বা মদনমঙ্গলা নামেও পরিচিত ছিলেন) একজন মধ্যযুগীয় বাংলা কবি। তাঁর জন্ম ১৫৬০ সিউড়ী ও কাটোয়ার অন্তর্বর্তী কাঁদরা নামক গ্রামে মঙ্গলাখ্য বিপ্রবংশে। তিনি ষোল শতকের পদাবলী সাহিত্যের একজন সেরা কবি। তাঁর সুনাম চন্ডীদাস বা বিদ্যাপতির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাঁর জীবন সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা জায় না। তিনি ছিলেন ভক্ত বৈষ্ণব সে জন্য তার পদে ভক্তের আবেগ বেশি পাওয়া যায়। সেকালের বটপত্রে জ্ঞানদাস সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য আছে।

শ্রীচৈতন্যের জীবনী লিখেছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ। তার চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে জানা যায়,জ্ঞানদাস নিত্যানন্দ শাখার একজন বৈষ্ণব। নিত্যানন্দ ছিলেন চৈতন্যের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং বাংলার বৈষ্ণব সমাজের খুব বড় নেতা। জ্ঞানদাসের অনেক পদে নিত্যানন্দের ভক্তি ও প্রশংসা আছে। পদগুলো পড়লে মনে হয় জ্ঞানদাস নিত্যানন্দকে অনেক কাছ থেকেই দেখেছিলেন। নিত্যানন্দের মৃতুর পর তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী জাহ্নবা দেবী বৈষ্ণব সমাজের নেত্রী হয়েছিলেন। জ্ঞানদাস ছিলেন জাহ্নবা দেবীর শিষ্য। চৈতন্যের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে বৈষ্ণব গ্রন্থগুলো প্রচারের দায়িত্ব যাঁরা নিয়েছিলেন, নরোত্তম দাস (আনুমানিক ১৫৪০-১৬১০) তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি রাজশাহী জেলার খেতুরি নামক স্থানে এক মহা উৎসবের আয়োজন করেছিলেন এবং উৎসবে বাংলাদেশের সব বৈষ্ণবকে ডেকেছিলেন। সেই মহামেলায় জ্ঞানদাসও অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তখন নাকি তাঁর বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছর। জ্ঞানদাস বলরাম দাস, গোবিন্দ দাস প্রমুখ বৈষ্ণব কবিদের সমসাময়িক হতে পারেন।

কারো মতে, তাঁর জন্ম ১৫৩০ সালে; কারো মতে ১৫২০ থেকে ১৫৩৫ সালের মধ্যে। জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাঁদড়া গ্রামে। নিত্যানন্দের জন্মস্থান একচক্রা বা একচাকা গ্রামের কাছাঁকাছি এই কাঁদড়া গ্রাম। এখানে জ্ঞানসাসের একটি মঠ আছে। জ্ঞানদাসের মৃত্যু উপলক্ষে প্রতিবছর পৌষ মাসের পূর্ণিমার সময় এই জায়গায় মেলা হয়। জ্ঞানদাস অবিবাহিত ছিলেন বলে জানা যায়। অন্যমতে, তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁর একটি পুত্র ছিল।

জ্ঞানদাস একজন উৎকৃষ্ট পদাকার ছিলেন। তাঁর কিছু স্মরনীয় পদ আছে। যেমন, রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর, কিংবা সুখের লাগিয়ে এ ঘর বান্ধিলুঁ ইত্যাদি। এই সব পদ বৈষ্ণব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। পদাবলীর গুণ ও মান বৃদ্ধিতে জ্ঞানদাসের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। ষোল শতক পদাবলীর স্বর্ণযুগ। জ্ঞানদাস এই স্বর্ণযুগের কবি। ভক্তের অনুভূতিকে কবিতায় প্রকাশ করার অপূর্ব প্রতিভা তাঁর মধ্যে ছিল।

শব্দব্যবহার ও ভাষাভঙ্গি একই রকম বলে জ্ঞানদাসকে চন্ডীদাসের অনুসারী বলা হয়। অকৃত্রিম সহজ রচনারীতির দিক থেকে চন্ডীদাসের সঙ্গে তাঁর মিল অবশ্যই আছে। কিন্তু জ্ঞানদাস একজন সতন্ত্র কবি। আধুনিক কালের গীতিকবিতার বৈশিষ্ট তাঁর পদে পাওয়া যাবে।

জ্ঞানদাসের নামে প্রায় শ'দুয়েক পদ চালু আছে। ব্রজবুলিতেও তিনি অনেক পদ রচনা করেছেন। তবে তাঁর বাংলা পদগুলো ব্রজবুলির পদের তুলনায় অনেক ভাল। জ্ঞানদাসের একটি বিখ্যাত পদ নিম্নরূপ:

“ রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।
ঘরে যাইতে পথ মোর হইল অফুরান
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর। ”

জ্ঞানদাস সঙ্গীত বিষয়েও একজন বিশেষজ্ঞ। একালে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল যেমন নিজেদের লেখার গানে সুর দিয়েছেন, সেকালে জ্ঞানদাসও একই কাজ করেছেন। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে জ্ঞানদাস বাংলা সাহিত্যে প্রথম ব্যক্তি, যিনি গান লিখে সুর দিয়েছেন। কীর্তন গানেও তাঁর দক্ষতা ছিল বলা হয়। কীর্তনের নতুন ঢঙ তিনি তৈরি করেছিলেন।

কিশোর বয়েস মণি কাঞ্চনে আভরণ
ভালে চূড়া চিকণ বনান |
হেরইতে রূপ- সায়রে মন ডূবল
বহু ভাগ্যে রহল পরাণ ||
সখি হে--পেখলুঁ পন্থক মাঝ |
হাম নারি অবলা একলা যাইতে পথে
বিছুরল সব নিজ কাজ ||
নয়ান-সন্ধান- বাণে তবু জর জর
কাতর বিনি অবলম্বে |
বসন খসয়ে ঘন পুলকে পুরল তনু
পানি না পূরলুঁ কুম্ভে ||
ঘর নহে ঘোর যেন জাগিয়া স্বপন হেন
আরতি কহনে না যায় |
জ্ঞানদাস কহে মনে অনুমানিয়ে
বাস করব নিপ-ছায় ||

*****
উপরে
**
কেন গেলাম জল ভরিবারে |
যাইতে যমুনার ঘাটে সেখানে ভুলিলুঁ বাটে
তিমিরে গরাসিল মোরে ||
রসে তনু ঢর ঢর তাহে নব কৈশোর |
আর তাহে নটবর বেশ |
চূড়া টালনী বামে মউর চন্দ্রিকা ঠামে
ললিত লাবণ্য রূপ-শেষ ||
ললাটে চন্দন পাঁতি নব গোরোচনা কাঁতি
তার মাঝে পূণিমক চাঁদ |
অলকা-বলিত মুখ ত্রিভঙ্গ-ভঙ্গিম রূপ
কামিনী জনের মন ফাঁদ ||
লোকে তারে কাল কয় সহজে সে কাল নয়
নীলমণি মুকুতার পাঁতি |
চাহনি চঞ্চল বাঁকা কদম্ব গাছে ত ঠেকা
ভূবন-মোহন রূপ-ভাঁতি ||
সঙ্গে ননদিনী ছিল সে সকল দেখি গেল
অঙ্গ কাঁপে থরহরি ডরে |
জ্ঞানদাসেতে কয় তারে তোমার কিবা ভয়
সে কি সতী বোলাইতে পারে ||

*******
উপরে
**
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল |
অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল ||
সখি কি মোর করমে লেখি |
শীতল বলিয়া ও চাঁদ সেবিনু
ভানুর কিরণ দেখি ||
উচল বলিয়া অচলে চড়িতে
পড়িনু অগাধ জলে |
লছিমি চাহিতে দারিদ্র্য বেঢ়ল
মাণিক্য হারানু হেলে ||
নগর বসালাম সায়র বাঁধিলাম
মাণিক পাবার আশে |
সাগর শুকাল মাণিক লুকাল
অভাগার করম-দোষে ||
পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবিনু
বজর পড়িয়া গেল |
জ্ঞানদাস কহে কানুর পিরীতি
মরণ অধিক শেল ||

********
উপরে
**
মাগো গেনু খেলাবার তরে |
পথে লাগি পেয়ে এক গোয়ালিনী
লয়ে গেল মোরে ঘরে ||
গোপরাজরাণী নন্দের গৃহিনী
যশোদা তাহার নাম |
তৈহার বেটার রূপের ছটায়
জুড়াইল মোর প্রাণ ||
কি হেন আকুতে তার বাম ভিতে
লয়ে বসাইল মোরে |
এক দিঠে রহি তাহার আমার
রূপ নিরিক্ষণ করে ||
বিজুরি উজোর মোর অঙ্গখানি
সেহ নব জলধর |
সুমেল দেখিয়া দিবাকর ঠাঁই
কি হেতু মাগল বর ||
তবে মোর গোরা গা-খানি মাজিয়া
লাস বেশ বনাইয়া |
হরষিত মোরে পাঠাইলা দেখ
এ সব আঁচরে দিয়া ||
ঝিয়ের কাহিনী শুনি গোয়ালিনী
মুচকি মুচকি হাসে |
কত সুধারস হিয়ায় বরিষে
কহে কবি জ্ঞানদাসে ||

******
উপরে
**
গগনে ভরল নব বারিদ হে
বরখা নব নব ভেল |
ঝর ঝর বাদর ডাকে ডাহুকী সব
শবদে পরাণ হরি নেল ||
চাতক চকিত নিকট ঘন ডাকই
মদন বিজয়ী পিকরাব |
মাস আষাঢ় গাঢ় বিরহ বড়
বরখা কেমলে গোঁয়াব ||
সরসিজ বিনু সর শোভা না পাবই
কমল না শোভে অলিহীনা |
হাম কমলিনী কান্ত দেশান্তর
কত না সহ দুখ দীনা ||
সঞ্চরু সঘন সৌদামিনী জনু
বিন্ধয়ে শর খরধার |
মাস সাঙনে আশ নাহি জীবনে
বরিখয়ে জল অনিবার ||
নিশি আন্ধিয়ার অপার ঘোরতর
ডাহুকি ডহ ডহ ভাখ |
বিরহিনী-হৃদয় বিদারণ ঘন ঘন
শিখরে শিখন্ডিনী ডাক ||
উনমতি শকতি আরোপয়ে কাম নিতি
জনু সব-সাধন লাগি |
ভাদর দর দর অন্তর দোলন
মন্দিরে একলি অভাগী ||
উলসিত কুন্দ কুমুদ পরকাশিত
নিরমল শশধর কাঁতি |
ঘরে ঘরে নগরে নগরে সব রঙ্গিণী
নাহি জানে ইহ দিনরাতি ||
চির-পরবাসী যতহুঁ পরদেশী
সব পুন নিজ ঘরে গেল |
মাস আশিন খীন ভেল কলেবর
জ্ঞান কহে দুখ কোন দেল ||

********
মিলনসাগর
উপরে
**
নিষ্ঠুর প্রেম

কান্দিতে না পাই বঁধু কান্দিতে না পাই |
নিশ্চয় মরিব তোমার চান্দমুখ চাই ||
শাশুড়ী ননদীর কথা সহিতে না পারি |
তোমার নিঠুরপনা সোঙরিয়া মরি ||
চোরের রমণী যেন ফুকারিতে নারে |
এমত রহিয়ে পাড়াপড়শী ডরে ||
তাহে আর তুমি সে হইলে নিদারুণ |
জ্ঞানদাস কহে তবে না রহে জীবন ||

********
উপরে
**
প্রেমদহন

মনেক মরম কথা শুনলো সজনি |
শ্যাম বন্ধু পড়ে মনে দিবস রজনী ||
কিবা রূপে কিবা গুণে মন মোর বান্ধে |
মুখেতে না ফুরে বাণী দুটি আঁখি কান্দে ||
কোন বিধি নিরমিল কুলবতী বালা |
কেবা নাহি করে প্রেম কার এত জ্বালা ||
চিতের আগুনি কত চিতে নিবারিব |
না যায় কঠিন প্রাণ কারে কি বলিব ||
জ্ঞানদাস কহে মুঞি কারে কি বলিব |
বন্ধুর লাগিয়া আমি সাগরে পশিব ||

********
উপরে
**
অভিমানিনী

পহিলহি চাঁদ করে দিল আনি |
ঝাঁপল শৈলশিখরে একপাণি ||
অব বিপরীত ভেল গো সব কাল |
বাসি কুসুমে কিয়ে গাঁথই মাল ||
না বোলহ সজনি না বোলহ আন |
কী ফল আছয়ে ভেটব কান ||
অন্তর বাহির সম নহ রীত |
পানি-তৈল নাহি গাঢ় পিরীত ||
হিয়া সম-কুলিশ বচন মধুরার |
বিষঘট-উপরে দুধ-উপহার ||
চাতুরি বেচহ গাহক ঠাম |
গোপত প্রেম-সুখ ইহ পরিণাম ||
তুহুঁ কিয়ে শঠি নিকপটে কহ মোয় |
জ্ঞানদাস কহ সমুচিত হোয় ||


ভক্তকবি গোবিন্দদাস কবিরাজ
ব্রজের মধুর লীলা, যা শুনি দরিবে শিলা, রচিলেন কবি বিদ্যাপতি।

তাহা হৈতে নহে ন্যূন, গোবিন্দের কবিত্বগুণ, গোবিন্দ দ্বিতীয় বিদ্যাপতি।।

(কবি বল্লভদাস)

"আধক আধ-আধ দিঠি অঞ্চলে যব ধরি পেঁখলু কান। কত শত কোটি কুসুমশরে জরজর রহত কি জাত পরান।।" (গোবিন্দদাস কবিরাজ)

চৈতন্য-উত্তর বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি গোবিন্দদাস কবিরাজ। ষোড়শ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা বলা চলে একাধারে সাধক, ভক্ত ও রূপদক্ষ এই কবিকেই। যৌবনের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়ে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন গোবিন্দদাস। অতঃপর রূপ গোস্বামীর উজ্জ্বলনীলমণি আয়ত্ত্ব করে বৈষ্ণব রসশাস্ত্র অনুসারে রচনা করতে থাকেন রাধাকৃষ্ণ-লীলা ও চৈতন্য-লীলার পদাবলি। তাঁকে বলা হয় বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। যদিও বিদ্যাপতির রচনার সঙ্গে তাঁর রচনার সাদৃশ্য ও বৈপরীত্য দুইই চোখে পড়ে। তাঁর একটি পদ ‘সুন্দরী রাধে আওয়ে বনি’ পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সুরারোপিত হয়ে আধুনিক অ-বৈষ্ণব সমাজেও সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

গোবিন্দদাসের জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ভক্তমাল গ্রন্থ, নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর ও নরোত্তমবিলাস (এই গ্রন্থদ্বয়ে কবির রচিত অধুনালুপ্ত সঙ্গীতমাধব নাটকের অংশবিশেষ উদ্ধৃত) ও রামগোপাল দাসের রসকল্পবল্লী কবির সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য জানা যায়। তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত শ্রীখণ্ডে এক বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চিরঞ্জিত সেন ছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ। জন্মকাল সঠিক জানা না গেলেও গবেষকেরা অনুমান করেন যে তিনি ষোড়শ শতকে মধ্যভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চিরঞ্জিত সেন ভক্তকবি দামোদর সেনের কন্যা সুনন্দাকে বিবাহ করে স্বগ্রাম কুমারনগর ত্যাগ করে বৈষ্ণবতীর্থ শ্রীখণ্ডে বসবাস শুরু করেন। সুনন্দা দেবীর গর্ভেই নৈয়ায়িক রামচন্দ্র ও তাঁর ছোটো ভাই কবিরাজ গোবিন্দদাসের জন্ম। প্রথম জীবনে গোবিন্দদাস শাক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। বৈষ্ণবধর্মে তাঁর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। যৌবনের শেষভাগে গ্রহণী রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মনে কৃষ্ণভক্তির উদয় হয়। তখন তাঁর দাদা রামচন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় শ্রীনিবাস আচার্য গোবিন্দদাসকে বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষিত করেন। গোবিন্দদাসের বয়স তখন ৪০। গদাধর প্রভুর প্রয়াণের সংবাদ পেয়ে শ্রীনিবাস আচার্য বৃন্দাবনে চলে গিয়েছিলেন। শ্রীখণ্ডের রঘুনাথ ঠাকুরের আদেশে রামচন্দ্র তাঁকে ফিরিয়ে আনতে যান। যাওয়ার আগে গোবিন্দদাসকে অধুনা মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলার কাছে তেলিয়া-বুধরী গ্রামে যেতে নির্দেশ দেন। শ্রীনিবাস আচার্য ফিরে এলে তিনি গোবিন্দদাসের কাছে কিছুকাল অবস্থান করেন। এই সময় তিনি গোবিন্দদাসের স্বমুখে তাঁর রচিত পদাবলি গান শুনতেন। এই সময়েই শ্রীনিবাস আচার্যের অনুরোধে গোবিন্দদাস গীতামৃত রচনা করেন। মুগ্ধ শ্রীনিবাস আচার্য তাঁকে ‘কবিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর তিনি বৃন্দাবনে তীর্থে গিয়ে জীব গোস্বামী, গোপাল ভট্ট প্রমুখের সম্মুখে নিজের পদাবলি গান করেন। ফিরে এলে ভক্তগণ তাঁকে নিয়ে মহোৎসব করেন। এই সময় নরোত্তম ঠাকুরের পিতৃব্যপুত্র রাজা সন্তোষ দেবের অনুরোধে তিনি ভক্তিমূলক নাটক সঙ্গীতমাধব রচনা করেন। গোবিন্দদাসের পুত্র দিব্যসিংহও পিতার ন্যায় ভক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর শেষজীবন তেলিয়া-বুধরীর পশ্চিমপাড়াতেই অতিবাহিত হয়েছিল।

গোবিন্দদাস ছিলেন সৌন্দর্যের কবি, রূপানুরাগের কবি। তিনি ভক্তি ও রূপের মধ্যে এক নিবিড় ঐক্যসাধনে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর পদগুলি ভাষা, অলংকার ও ছন্দের সৌন্দর্যে এবং ভাবের গভীরতায় পরিপূর্ণ। রূপসৌন্দর্যের ভাবপ্রতিমা সৃজনে তিনি কতদূর সক্ষম হয়েছিলেন তা পূর্বরাগের এই পদটির বর্ণনা থেকেই পরিস্ফুট হয় –

যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।

তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি।।

এই তীব্র রূপাসক্তিই ছিল গোবিন্দদাসের কাব্যরচনার মূল। তাঁর ভক্তি যত বেড়েছে, যতই তিনি সাধনার উচ্চস্তরে উপনীত হয়েছেন, ততই এই রূপমুগ্ধতা তাঁকে নিয়ে গেছে পূর্ণতার দিকে।

রাসাভিসারের পদে গোবিন্দদাসের জুড়ি সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যে নেই। এই সকল পদে ছন্দে, সুরে, ভাবে ও ভাষায় যে স্বতঃস্ফুর্ত উল্লাস ঝরে পড়েছে, তা অনুধাবন করতে এই একটি পদই যথেষ্ট:

শরদ চন্দ পবন মন্দ বিপিনে ভরল কুসুমগন্ধ।

ফুল্ল মল্লিকা মালতী যূথী মত্ত মধুকর ভোরণী।।

হেরত রাতি ওছন ভাতি শ্যামমোহন মদনে মাতি।

মুরলী গান পঞ্চম তান কুলবতী-চিত-চোরণী।।

শুধু রাসাভিসারই নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অভিসারের পদে গোবিন্দদাসের জুড়ি নেই। অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মতে, অভিসারের পদে গোবিন্দদাস রাজাধিরাজ। সৃষ্টির আদি মুহুর্ত থেকে বিবর্তনের পথে মানবজীবনের অগ্রগতির সঙ্গে অভিসারের ধারণাটি সম্পৃক্ত। অভিসারের অর্থ নিছক সঙ্কেতস্থানে মিলনার্থে প্রণয়ী-প্রণয়িণীর গুপ্তযাত্রা নয়, অভিসারের অর্থ কাম্যবস্তু লাভে কঠোর কৃচ্ছসাধন। জয়দেব অভিসারের কথা বলেছেন কোমল-কান্ত সুরে – ‘চল সখি কুঞ্জং সতিমির পুঞ্জং শীলয় নীল নিচোলম্।’ কিন্তু গোবিন্দদাসের অভিসার অনেক পরিণত। এই অভিসার সাধনার নামান্তর –

মন্দির বাহির কঠিন কপাট।

চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।

তঁহি অতি দূরতর বাদল দোল।

বার কি বারই নীল নিচোল।।

সুন্দরী কৈছে করবি অভিসার।

হরি রহ মানস সুরধুনী পার।।

ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত।

শুনইতে শ্রবণে মরম মরি জাত।।

দশ দিশ দামিনী দহই বিথার।

হেরইতে উচকই লোচনভার।।

ইথে যদি সুন্দরি তেজবি গেহ।

প্রেমক লাগি উপেখবি দেহ।।

গোবিন্দদাস কহ ইথে কি বিচার।

ছুটল বাণ কিয়ে নয়নে নিবার।।

গোবিন্দদাসের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদেও পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মিলন, বিরহ, মাথুর প্রভৃতি পর্যায় আছে। তাঁর রাধার মধ্যেও বাসকসজ্জা, খণ্ডিতা, মান-অভিমান, কলহান্তরিতা দশা লক্ষিত হয়। বিদগ্ধ গোবিন্দদাস অন্তর-সংঘাতে বিধ্বস্ত রাধার আত্মগ্লানি, দীনতা, মিনতি পরিস্ফুট করেছেন উৎকৃষ্ট ভাব ও ভাষায়। তবে বিরহের পদে তাঁর সার্থকতা নেই। তিনি আরাধনার কবি। প্রেমের কবি। তাঁর রূপোল্লাসের প্রদীপে বিরহের অন্ধকার অপহৃত হয়েছে।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন গোবিন্দদাসের জীবনদেবতা। স্বীয় পদে তিনি এঁকেছেন দিব্যভাবচঞ্চল মহাপ্রভুর অন্তর্জীবনের ছবি –

নীরদ নয়নে নীর ঘন সিঞ্চনে পুলক মুকুল অবলম্ব।

স্বেদমকরন্দ বিন্দু বিন্দু চূয়ত বিকশিত ভাবকদম্ব।।

গোবিন্দদাসকে বলা হয় বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। কবি বল্লভদাস তাঁকে বলেছেন দ্বিতীয় বিদ্যাপতি। তবে বিদ্যাপতির সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য নিছকই ভাষাগত। ভাবগত নয়। বিদ্যাপতির ভাষা ব্রজবুলি। গোবিন্দদাসের ভাষাও বাংলা-অনুসারী ব্রজবুলি। এমনকি তাঁর খাঁটি বাংলা পদও দুর্লভ নয় –

ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণী অবনী বহিয়া যায়।

ঈষৎ হাসির তরঙ্গহিল্লোলে মদন মুরছা পায়।।

ছন্দ-অলংকারের ঝংকারে ধ্বনিমাধুর্যে গোবিন্দদাসের পদ বিদ্যাপতির সমতুল। কিন্তু বিদ্যাপতির পদে ভক্তের আকুতি অনুপস্থিত। তিনি জীবনরসিক কবি। মনে রাখতে হবে, ধর্মক্ষেত্রে বিদ্যাপতি ছিলেন শৈব। গোবিন্দদাস, অন্যদিকে, স্বয়ং বৈষ্ণবই শুধু নন, ষোড়শ শতাব্দীর বৈষ্ণব ধর্মনেতাদের অন্তরঙ্গও বটে। চৈতন্য-প্রবর্তিত ভক্তিধর্মের অন্যতম রসভাষ্যকার গোবিন্দদাস কবিরাজ। বিদ্যাপতি সভাকবি, গোবিন্দদাস ভক্তকবি। স্বভাবতই, বিদ্যাপতির পদে আছে বুদ্ধির দীপ্তি, রাজকীয় আভিজাত্য। সেখানে ভক্তি এসেছে কদাচিত। কিন্তু গোবিন্দদাসের সব ছন্দ, সব অলংকার, সকল ধ্বনির এক এবং একমাত্র গতি হল ভক্তি। রাধাকৃষ্ণ-প্রেমলীলার অন্তর্নিহিত সত্যটি যে সেই জীবাত্মা-পরমাত্মার অপার্থিব সম্পর্ক – সেই বৈষ্ণব তত্ত্বের অনুভূতিরই অন্যতম প্রকাশস্থল গোবিন্দদাসের পদাবলি। এই প্রসঙ্গে তাঁর অভিসার পর্যায়ের পদগুলির উল্লেখ করা যেতে পারে – যেখানে তাঁর প্রতিস্পর্ধী কবি বৈষ্ণব সাহিত্যে বিরল।

For Post Link Click Here

0 comments