Monday 6 June 2016

প্রসঙ্গ রবীন্দ্র সংগীতে কীর্তন

রবীন্দ্র সংগীতে কীর্তন

বাংলার কীর্তন অতি প্রাচীন ও সুপরিচিত একটি গাঁথা বা ধারা। রবীন্দ্রপূর্ব যুগেও এদেশে কীর্তন গানের যথেষ্ট কদর ছিল। ঈশ্বরের যশোসূচক গান বাংলায় পূর্ব থেকে প্রচলিত হলেও তাঁর লীলাত্মক কীর্তন গান ও বাংলায় সমান গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলার কীর্তন গানের সুর মনকে আন্দোলিত করে তুললেও এ গানে ঈশ্বর যেন এক বিরাটতত্ত্বের বিস্ময়। হয়তো বা সে কারণেই দেশি সঙ্গীতের এই ধারাটি তখনকার ইংরেজি জানা নব্যশিক্ষিত সুধীজনদের কাছে নিকৃষ্ট শ্রেণির সংগীত বলেও আখ্যায়িত হয়েছিল। আর তারই কারণে প্রাচীন বাংলার কীর্তন স্থান পেয়েছিল কেবল বটতলার বৈষ্ণব ভিক্ষুকদের কণ্ঠে।

রবীন্দ্রনাথ ত্রিশ বছর বয়সে রাজশাহী ও কুষ্টিয়া জেলার জমিদারি কাজের ভার গ্রহণ করতে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে আসেন এবং বাংলার এই প্রাচীন গাঁথাটির সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে গভীরভাবে। কবি বাংলার গ্রাম-অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলার প্রাচীন কীর্তনের প্রবল সুরের ধারায় রচিত করলেন তাঁর রাবিন্দ্রীক কীর্তন গানগুলোকে।

রাবীন্দ্রিক কীর্তন গান কথার অর্থধ্বনিকে সুরের বৃষ্টিধারার মধ্যে টেনে নিয়ে গেছে অরূপের অভিসারে। রাবীন্দ্রিক কীর্তনে অন্তর্যামী যিনি জীবন দেবতাও তিনি, লীলাসঙ্গিনীও তিনি। রবীন্দ্রনাথের ধর্ম গভীর ধর্ম। রাবীন্দ্রিক কীর্তনে কবি যেন তাঁর অন্তরে ভক্তিকে নৈবেদ্য করে সাধনার নামে উৎসর্গ করতে চেয়েছেন ঈশ্বরের চরণে। জীবনের প্রথমার্ধে রাধা কৃষ্ণের প্রেম উপলক্ষ করে কীর্তন সুরের গান রচনা করলেও পরিণত বয়সে কবি কীর্তনগানে বপন করলেন লৌকিক প্রেমের বীজ, একটি শাস্ত্রাচারবিমুক্ত সহজিয়া জীবনবোধ ও অতীন্দ্রিয় আনন্দানুভূতির সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায় রাবীন্দ্রিক কীর্তন গানে।

বাংলা কীর্তনের সুর ও ছন্দ আমার মনকে নাড়া দেয় ভীষণভাবে। রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে এ সুরের আশ্রয় নিয়ে রচনা করেছেন বহু গান। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি আমি বরাবরই দুর্বল এবং তাঁর রচিত রাবীন্দ্রিক কীর্তন গানগুলো আমার দুর্বলতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ। রাবীন্দ্রিক কীর্তনের প্রতি আমার এই অনুরাগের কারণেই আমি গবেষণার জন্য বিষয়টিকে নির্বাচন করেছি, যার নাম দিয়েছি ‘রবীন্দ্র সঙ্গীতে কীর্তন প্রসঙ্গ’।

কীর্তন

‘কীর্তন’ শব্দটি ভক্তিরসাত্মক গান বা ঈশ্বর ও অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে গীত ভজনগানকেই বোঝায়। ‘কীর্তন’ শব্দ খ্যাতি, মহিমা ও যশোসূচক গানকে বোঝায়। শাস্ত্রে কীর্তন ‘যশোগান’ বা ‘কীতিগাথা গান’ নামে পরিচিত। অতএব, কীর্তন বলতে আধ্যাত্ম ভাবসম্পদযুক্ত গীতি বা গানকে বোঝানো হয়। প্রাচীনকাল থেকে ভগবানের নাম গুণ লীলা উচ্চৈঃস্বরে কীর্তনের প্রথা ভারতে সর্বত্র প্রচলিত হলেও বাংলায় শ্রী চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) প্রভাবেই কীর্তন গানের ব্যাপক অনুশীলন ও প্রচলন ঘটে। বাংলার কীর্তনের নিজস্ব একটি ঐতিহ্য ও রূপ আছে। এর রসস্নিগ্ধ পদসাহিত্য ও সুর মানুষের মনকে সহজেই মহিত ও উদ্বেলিত করে। বাঙালির রসভাবসম্পৃক্ত হৃদয়াবেগ ও নিবিড় অন্তরাভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বাংলার কীর্তনে। কীর্তন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-

‘কীর্তনে জীবনের রসলীলার সঙ্গে সংগীতের রসলীলা ঘনিষ্ঠভাবে সম্মিলিত। জীবনের লীলা নদীর স্রোতের মত নতুন নতুন বাঁকে বিচিত্র। ডোবা বা পুকুরের মতো ঘেড় দেওয়া পাড় দিয়ে বাঁধ নয়, কীর্তনে এই বাঁধা ধরায় পরিবর্তনমান ক্রমিকতাকে কথায় ও সুরে মিলিয়া প্রবেশ করিতে চাহিয়াছিল।’

রবীন্দ্রনাথ ও ভানুসিংহ পদাবলী

রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহের পদাবলীতে রাধা কৃষ্ণের প্রেম উপলক্ষ করেই প্রথম কীর্তন সুরের গান রচনা করেছিলেন। ‘গহন কুসুমকুঞ্জ মাঝে’ কবির ষোলো বছর বয়সের লেখা। এখন প্রশ্ন উঠে বৈষ্ণব পদাবলী অনুকরণ করে কাব্যরচনার প্রেরণা কেমন করে ও কোথা থেকে পেলেন। ১৮৭৫ সালে পিতার সঙ্গে নৌকাভ্রমণে গিয়ে তার বইগুলোর মধ্যে প্রতি পুরাতন ফোর্ট উইলিয়ামের প্রকাশিত ‘গীতগোবিন্দ’ খুঁজে পেয়েছিলেন। গদ্যরীতিতে বইখানি ছাপানো ছিল, কিন্তু তাহলেও ছন্দের টানে খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে জয়দেবের বিচিত্র ছন্দকে আত্মস্ত করতে প্রায় দু’বছর সময় লেগেছিল রবীন্দ্রনাথের। এই বইখানি অধ্যয়নের পদ্ধতি ছিল কিশোর কবির নিজস্ব। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-

“আমি টীকার ওপর নির্ভর না করিয়া নিজে বুঝিবার চেষ্টা করিতাম। বিশেষ কোনো দুরূহ শব্দ যেখানে যতবার ব্যবহৃত হইয়াছে সমস্ত আমি একটি ছোট বাঁধানো খাতায় নোট করিয়া রাখিতাম। ব্যাকরণের বিশেষত্বগুলোও আমার বুদ্ধি অনুসারে যথাসাধ্য টুকিয়া রাখিয়াছিলাম।"

রবীন্দ্রনাথের এই প্রস্তুতির সাথে যোগ হল অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর কাছ থেকে শোনা ইংরেজ বালক- কবি চ্যাটার্টনের কাহিনী। চ্যাটার্টন পঞ্চদশ শতকের টমাস রাউলি নামক এক কবির কাব্য আবিষ্কার করেছিলেন বলে দাবি করেন এবং নিজের কবিতাগুলো প্রাচীন কবির রচনা বলে প্রকাশ করেন।

রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ পাঠ করলে আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথও চ্যাটার্টন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজে ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। বালক রবি এক বয়স্ক বন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন যে, এই পদাবলী ভানুসিংহ নামে এক প্রাচীন পদকর্তা দ্বারা রচিত এবং পুঁথিখানি আদি ব্রাহ্মসমাজ গ্রন্থশালায় আবিষ্কৃত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়ণ্ড

“চ্যাটার্টনের আত্মহত্যার অনাবশ্যক অংশটুকু হাতে রাখিয়া কোমর বাঁধিয়া দ্বিতীয় চ্যাটার্টন হইবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলাম।

রবীন্দ্রনাথের তেরো থেকে আঠারো বছর বয়সের মধ্যে রচিত প্রায় সকল কাব্যই তিনি কাব্যগ্রন্থাবলী থেকে বাদ দিয়েছিলেন, কেবল রেখেছিলেন ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বাংলা সাহিত্যের এমন একটা যুগ ছিল যখন বাংলার শ্রেষ্ঠ সম্পদ শিক্ষিত সমাজের নিকট প্রায় অজ্ঞাত ছিল।

“. . .বৈষ্ণব কবিতার যে শুধু সমাদর ছিল না এমন নহে, তাচ্ছিল্য ভাবও লক্ষিত হইত। . . . বটতলার নিকৃষ্ট পুস্তকালয়ে বৈষ্ণব ভিক্ষুকের কণ্ঠে আশ্রয় লাভ করিয়াছিল।”

ভারতীতে প্রথম যে কবিতাটি ছাপানো হল, তার নাম ছিল ‘ভানুসিংহের কবিতা’। কিন্তু এ কবিতাগুলো সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের কোনো মোহ ছিল না। ‘জীবন স্মৃতি’ রচনাকালে তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন, ‘ভানুসিংহের কবিতা’ একটু বাজাইয়া বা কষিয়া দেখিলেই তাহার মেকি বাহির হইয়া পড়ে।”

রবীন্দ্রনাথ যে বয়সে ভানুসিংহ পদাবলী রচনা করেছিলেন, সেই বয়সটা ছিল অনুকরণের। আর তাই অনুকরণ করাটা তাঁর কাছে বেশ সহজ হয়েছিল। প্রাচীন পদকর্তাগণ যে ভাষায় পদাবলী রচনা করেছিলেন সে ভাষাটা নকল করা সহজ কিন্তু ভাবটি কবির স্বকীয়। ভাবের মধ্যে কৃত্রিমতা ছিল না, ভাবের ঘরে চুরি করা কঠিন। মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান’ এখানে উল্লেখ্য যে, বৈষ্ণব পদাবলীতে ‘মরণ’ শ্যামের সহিত উপমিত হয় নি, শ্যাম ‘সুন্দর’ বলা হয়েছে। বাংলার শিক্ষিত সমাজ অর্থাৎ ইংরেজি জানা সম্প্রদায় আধুনিক যুগে সর্বপ্রথম বৈষ্ণব পদাবলীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন যার মাধ্যমে তা হল বাংলা সাপ্তাহিক ‘ অমৃতবাজার পত্রিকা’ (২৮ মার্চ, ১৮৭০)। অবশ্য তারও আগে মাইকেল মধুসূদন ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্যে’ (১৮৬১) বৈষ্ণব ভাবের কবিতা রচনা করেন সত্য, কিন্তু ব্রজভাষার ব্যবহার করেননি তাতে, তবে আধুনিক কবিতায় সর্বপ্রথম ব্রজভাষা ব্যবহার করেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি মৃণালিনী উপন্যাসে তিনটি গান ব্রজভাষায় রচনা (১৮৬৯) করেন। ব্রজবুলিকে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক উপভাষা বলা হয়, কেননা বঙ্গদেশে এর উদ্ভব এবং বাঙালি কবিদের হাতেই এর পরিপুষ্টি। এই ভাষায় রাধা কৃষ্ণের ব্রজলীলা বর্ণনা করা হয়েছে বলেই এর নাম ব্রজবুলি। ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত ব্রজবুলিতে বৈষ্ণবপদ রচনা করা হয়। এ প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ্য যে, “শুধুই বড়ণ্ড চণ্ডীদাস নন, পরবর্তী বৈষ্ণবমহাজন রচয়িতারা কীর্তনের পদ বা পদ সাহিত্য রচনা করেছেন গীতগোবিন্দের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। . . . তাছাড়া গীতগোবিন্দের পদগানের পটভূমিকাও যে রচিত হয়েছিল বৌদ্ধ চর্যাগীতির গায়নরীতি ও প্রকাশশৈলীর ভাব গ্রহণ করে একথা স্বীকার করা যায় না।”

তবে একথা অনস্বীকার্য যে, প্রাচীন পদকর্তাদের এমন নকল করা পদাবলী রবীন্দ্রনাথের পূর্বে কেউ লিখতে পারেন নি।

অবশ্য ঢপ নামে কীর্তনের আর একটি ধারার কথাও শোনা যায়। কিন্তু একথা সত্য যে, এই সকল কীর্তন গানের লয়-ছন্দ, সুরের কারিগরি ও মাত্রার জটিলতার সমৃদ্ধ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রচিত কীর্তন গানগুলো ভালো করে অনুশীলন করলে দেখা যায় এর সুরগুলো সহজ ও সরল। গুরুগম্ভীর সুরের বা তালের গান এ নয়। এর সুরে আছে বাঁশির মতো উদাস-করা ব্যথায়-ভরা একটি আবেগ। গানগুলোর ভাষা ও সুরের সামঞ্জস্য মনকে আকর্ষণ করে। সকলে সহজে যেন কীর্তনের রস গ্রহণ করতে পারে রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিল সেদিকেই। আর তাই তাঁর কীর্তন গানগুলোতে ঈশ্বর যেন প্রেমিকরূপে দেখা দেন। যিনি পরম, তিনি যদি প্রিয় না হন, তিনি যদি আপনার জন না হন, তাঁকে যদি আত্মীয় সম্বন্ধের যোগে না বাঁধতে পারা যায়, তবে কেমন করে হবে মিলন? তাই হৃদয়ভূমিতে তাঁকে আবাহন। ভগবানের সঙ্গে মিলনের আকঙক্ষা প্রবল হয়েছে কবির রচিত এই গানের মধ্য দিয়ে-

‘আমার মন মানে না দিন রজনী

আমি কী কথা স্মরিয়া এ তনু ভরিয়া পুলক রাখিতে নারি। (স্বরবিতান-১০)

এই গানটির সরলতার মাধুর্য মানব মনকে একটি অনির্বচীয় বিরহ বেদনায় অশ্রু ব্যাকুল করে তোলে, ‘কী ভাবিয়া মনে এদুটি নয়নে উথলে নয়নবারি....‘ভক্তের এই ব্যাকুল আহবানে ভগবান সাড়া না দিয়ে পারেন না। আর তখনই চলে মিলনের খেলা। প্রেমের একদিকে দ্বৈত, আর একদিকে অদ্বৈত। একদিকে বিচ্ছেদ, আর একদিকে মিলন। একদিকে বন্ধন, আর একদিকে মুক্তি-যার মধ্যে শক্তি এবং সৌন্দর্য, রূপ এবং রস, সীমা ও অসীম এক হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-

‘যেতে যেতে চায় না যেতে, ফিরে ফিরে চায়-

সবাই মিলে পথে চলা হল আমার দায় গো ॥

দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে-দেয় না সাড়া হাজার ডাকে

বাঁধন এদের সাধনধন, ছিঁড়তে যে ভয় পায় ॥ (স্বরবিতান-৪৪)

রবীন্দ্রনাথের গানে ভগবানের সঙ্গে মিলনের আকাঙক্ষা যখন প্রবল হয়েছে, ভগবান তখন বন্ধু, প্রিয়, দ্বৈত, স্বামী, নাথ, ও সখার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন কবির গানে। রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গানের সাথে বাংলার পূর্ব প্রচলিত কীর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভেদটি হল রবীন্দ্রনাথের একদিকে যেমন সযত্নে, পরিহার করেছেন ত্রিতাল, চৌতাল, ধামার, আড়াচৌতাল, সুরফাক্তাল ইত্যাদি উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালগুলো, ঠিক তেমনি এটি গ্রাম-বাংলার পূর্ব প্রচলিত বাউল ও সারিগানের মতো কেবল চার বা তিন মাত্রা ছন্দের তালে বাঁধা নয়, এতে তিন বা চার মাত্রা ছন্দের তাল ছাড়াও ও তেওড়া, ঝাঁপতালও স্থান পেয়েছে, যেমন-

১. ওরা অকারণে চঞ্চল-চার মাত্রার ছন্দ
২. আমার কী বেদনা সে কি জানো-তিন মাত্রার ছন্দ
৩. যেতে যেতে চায় না যেতে-ঝাঁপতালের ছন্দ
৪. লহো লহো তুলে লহো-তেওড়া আলের ছন্দ

আখরযুক্ত রাবীন্দ্রিক কীর্তন

রাবীন্দ্রিক কীর্তনের একটি বিশেষ অঙ্গ ‘আখর’ সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক। রবীন্দ্রনাথ আখরকে বলেছেন ‘কথার তান।’ তানে যেমন সুরের বিস্তার, আখরে তেমনি ভাবের বিস্তার। ঊনবিংশ শতাব্দীর গীতিকারদের মতো রবীন্দ্রনাথও তাঁর কীর্তন গানে গায়কদের আখর দেবার স্বাধীনতা দেননি। কিন্তু আখর দিয়ে গাইবার ইচ্ছা যে তাঁর ছিল না এ আমরা বুঝি তাঁর আখর দেওয়া গানের স্বল্পতায়। জীবনের প্রথমার্ধে কয়টি গানে আখর দিয়েছিলেন, কিন্তু সুর যোজনার দিক থেকে এই সব গানে নিজের কোনোরকম শিল্পনৈপুণ্যের প্রকাশ নেই। অধিকাংশ গান অনেকগুলো কলিতে বিভক্ত প্রথম দুই কলির হুবহু অনুকরণে অন্যসব কলিতে সুর বসিয়েছেন। পরবর্তী জীবনে এ ধরনের আখর দেওয়া গান আর লিখলেন না তিনি। বহু বৎসর পরে, মৃত্যুর বছর কয়েক আগে, ১৯৩৭ সালে বর্ষামঙ্গলের জন্যে রচিত “আমি শ্রাবণ আকাশে ওই’ গানটিতে এর ব্যতিক্রম দেখি। এতে আখর জুড়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল আখর সমেত গানটি অনুষ্ঠানে গীত হবে। কিন্তু তা হয়নি। আখর সমেত গানটি গাইবার সময় দেখা গেল, আখর যেন নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবার জন্য ব্যস্ত। তাই আখরের প্রতি মমতা না দেখিয়ে বর্ষামঙ্গলের অনুষ্ঠানে মূলগানটিই গাইয়েছিলেন আখর বাদ দিয়ে।

রবীন্দ্রনাথ ও বাউল কীর্তন

বাউল হল বাংলার মুক্তিপাগল সংগীত সাধক। এদের জীবনে সুরই হল প্রাণ, সুরই হল আনন্দ, সুরই কথা। এরা সুরের ভিতর দিয়ে জীবনের মূল সত্যকে বুঝতে চেষ্টা করে। শাস্ত্রের অনুশাসন দ্বারা এরা নিয়ন্ত্রিত নয়। এরা প্রেমের সাধন করে, এদের ভালোবাসা অধবার প্রীতি। অধরাকে ধরতে হলে ধরা-র সঙ্গ করা চাই। ধরার জগৎ রূপের জগতের আনন্দকে আগে বুঝতে হবে, তবেই অধরাকে ধরা যাবে। রবীন্দ্রনাথের ৫৪ বৎসর বয়সে রচিত ‘এই তো ভালো লেগেছিল’ গানটি বাউলের সহজিয়া জীবনবোধের সংমিশ্রণে একটি সম্পূর্ণ নতুন ঢঙের কীর্তন গান। গানটি বাউল-কীর্তন মিশ্রিত সুরের একটি অপূর্ব নিদর্শন। মানুষের সব প্রবণতা, সব অনুভূতি কবির কাছে ‘সুন্দর’ হয়ে দেখা দিয়েছে, আর তাই তার প্রকৃতির গান, প্রেমের গান, পূজার গান সব একাকার হয়ে গেছে। প্রকৃতিও যেন ঈশ্বর হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এভাবেই বাংলার বাউল গান রবীন্দ্রনাথের হাতে সংস্পর্শে প্রচলিত বাউলদের গানের ঢঙ অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ সীমা থেকে ধীরে ধীরে বড়ো ও বিচিত্র হয়ে রাবীন্দ্রিক বাউল কীর্তনে প্রকাশ লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের কীর্তন গানে ঈশ্বরানুভূতি কেবল ভক্তি নয়, অন্তর উপলব্ধি ও আত্মোপলব্ধির আনন্দও আছে। তাঁর কীর্তন গানের মধ্য দিয়ে তিনি ক্রমেই বহির্জগতের কলকোলাহল থেকে সরিয়ে এনে বিশ্বশ্বরের নিভৃতশালার বিশাল প্রাঙ্গণে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। কেবল কক্তের উদ্‌গত সুর দিয়ে তাঁর আরতি। অন্তরলোকের ধ্যানই যেন মুখ্য। আত্মমগ্ন ঔদাসীন্য ও কর্তব্যপরায়ণতার মধ্যবর্তী মনোভাবকে অতিক্রম করে একটি শাস্ত্রাচারবিমুক্ত সহজিয়া জীবনবোধ ও অতীন্দ্রিয় আনন্দানুভূতির লক্ষ্য করা যায় রাবীন্দ্রিক কীর্তনে।

সাধনা কেবল ভক্তের আবেগ উচ্ছ্বাস নয়, চিত্তকে ঈশ্বরের চরণে নিবেদিত রাখার জন্যই সংকল্পের প্রয়োজন আছে। তাই কবি যেন নিবেদনের ভঙ্গিতে বলেছেন-

‘ওই আসনতলে মাটির পরে লুটিয়ে রব’

গানই যেন কবির কাছে ঈশ্বরৈষণার পরমশনি। তাঁর রাবীন্দ্রিক কীর্তনের মধ্যে ঈশ্বরের ঐশ্বর্যময় রূপ নয়, মাধুর্যময় রূপই প্রধান উপলব্ধির বিষয়, তাঁর সর্বঈশ্বরবোধ গানের ব্যাপ্তিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। জীবনের শেষ অর্ধেই এই ধরনের গান রচনা করেছেন কবি সবচেয়ে বেশি। পরিশেষে বলা যায়, রাবীন্দ্রিক কীর্তন বলতে আমরা যা বুঝি তা হল বাংলার নিজস্ব সুর ও ঢঙে রচিত রবীন্দ্রনাথের আর একটি নতুন সৃষ্টি। এ যেন পূর্ব বঙ্গের গ্রাম-অঞ্চলের কীর্তন ও বাউল সুরের মিশ্রণে সৃষ্ট এক বিশেষ সুরে গান।

তথ্যসূত্র: দৈনিক আজাদী।

0 comments