Monday 6 June 2016

রবীন্দ্র সাহিত্যে গানের অনুষঙ্গ


বাংলা গীতিকবিতায় যে ক’জন কবি অমৃত সঞ্চার করেছেন এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছেন বাঙালি মনের মাধ্যমে বিশ্বসভায়, তাঁদের মধ্যে প্রধানতম দু’জন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) নিঃসন্দেহে। দ্বীজেন্দ্রলাল (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত (১৮৬৫-১৯১০) ও অতুল প্রসাদ (১৮৭১-১৯৩৪), এঁদের গানের উপযোগিতাও অনেক বেশি, তবে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গানের মতো বৈচিত্রময় নয়। নজরুল গান নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছেন অনেক, সৃষ্টি করেছেন বহুরাগিনীর সংযোগে অসংখ্য গান। শুধু তা-ই নয়, নজরুল ইসলামের আর একটি কৃতিত্ব হলো, তিনি নির্ঝরিণী, রেণুকা, মীণাক্ষী, সন্ধ্যামালতী, বনকুন্তলা, দোলনচম্পা প্রভৃতি নাম উল্লেখ করে নিজস্ব সুর সৃষ্টি করেছেন। তিনি যতটা সঙ্গীতের সংগঠক, ঠিক ততটা সুরস্রষ্টাও। তবে এ কাজগুলো যেন কতকটা গীতিকার, সুরকার আর কণ্ঠকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছে। এর দেউড়ির বাইরে বিস্তার লাভে অতটা সফল হননি। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু গীতিকার কিংবা সুরকারই নন, সঙ্গীতসাধক বা গবেষকও বটে। তাঁর রচনার প্রতিটি ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে এসেছে গানের অনুষঙ্গ। যা কখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গবেষণার ঢঙে আবার কখনো সহজাতভাবে। আসলে রবীন্দ্রনাথের শিরা আর ধমণীর মধ্যে যে দেয়া নেয়া, তার মাঝেও ছিল গানের অনুষঙ্গ। কি গদ্যে কি পদ্যে, কি হরিষে কি বিষাদে, কি স্বয়ং গানের মধ্যেও ‘গান’ চলে এসেছে কত সহজাত ভাবে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ডায়েরি লেখার সময়, কোনো বিশেষ প্রসঙ্গে চলে এসেছে গানের অনুষঙ্গ। তিনি ডায়েরি লেখাতে কোনো এক বিশেষ অবতারণায় গানের প্রসঙ্গে বলেছেন—‘গান জিনিসটা নিছক সৃষ্টিলীলা। ইন্দ্রধনু যেমন বৃষ্টি আর রৌদ্রের জাদু, আকাশের দুটো খামখেয়ালি মেজাজ দিয়ে গড়া তোরণ, একটি অপূর্ব মুহূর্তকাল সেই তোরণের নিচে দিয়ে জয়যাত্রা করবে।... ... মেজাজের এই রঙিন খেলাই হচ্ছে গীতিকাব্য’ (যাত্রী। পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি)। গানের সম্বন্ধে এত কঠিন কথার এত সহজ ব্যাখ্যা হয়তো আর কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব ছিল না। ঠিক একইভাবে রবীন্দ্রনাথ যখন উপন্যাস লিখতে বসেছেন তখনো গান তাঁর সঙ্গছাড়া হয়নি। গানের গুনগুনানি তাঁর উপন্যাসকে করেছে আরো তাত্ত্বিক আরো সরস। যেমন ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে রয়েছে বেশকিছু গানের অবতারণা। শুধু তা-ই নয়, গানের স্বরূপও সেখানে বলতে চেয়েছেন এভাবে—‘সংসারে ক্ষুদ্রকালটাই সত্য হয়ে দেখা দেয়... চিরকালটা থাকে আড়ালে; গানে চিরকালটাই আসে সামনে, ক্ষুদ্র কালটা যায় তুচ্ছ হয়ে, তাতেই মন মুক্তি পায়।’ অর্থাত্ রবীন্দ্রনাথ যেখানে যে বিষয়েই কথা বলুন না কেন, কোনো না কোনোভাবে সচেতন কিংবা অচেতনভাবে হলেও চলে এসেছে গানের প্রসঙ্গ, গানের অনুষঙ্গ।


রবীন্দ্রনাথের গানের ভুবন শুধু গানের আর সুরের ইন্দ্রজাল বিস্তার করে সবাইকে আকৃষ্টই করেননি, করেছেন চিন্তাযুক্তও। মানুষের দিব্যকান আর দিব্যমনকে একসাথে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। তাই কবি কখনো তাঁর কোনো গানে একের মাধ্যে অনেক হয়ে ধরা দেন সহজ আর সাবলীলভাবে। মানুষ তখন ওই গান আর শোনার মধ্যে শুধু থাকেন না, করতে থাকেন গানকে আত্মস্থ। হূদয়ঙ্গম করতে থাকেন চিন্তার রঙে। একজন সাধারণ শ্রোতাকে রবীন্দ্রনাথ খুব সহজেই করে তুলতে পারেন বড় বোদ্ধা শ্রেতা হিসেবে। যখন কবির গানের কথাগুলো হয় এমন—‘ঘরে আমার রাখতে যে হয় বহু লোকের মন-/ অনেক বাঁশি, অনেক কাঁসি, অনেক আয়োজন।/ বঁধুর কাছে আসার বেলায় গানটি শুধু নিলেম গলায়,/ তারি গলার মাল্য ক’রে করবো মূল্যবান।’ (গীতবিতান। রাজপুরীতে বাজায় বাঁশি)


ঠিক একই ধাঁচের আরো দু-একটি গানের শরীর এখানে তুলে ধরা যেতে পারে—‘যে গান কানে যায় না শোনা/ সে গান যেথায় নিত্য বাজে,/ প্রাণের বীণা নিয়ে যাব/ সেই অতলের সভামাঝে।/ চিরদিনের সুরটি বেঁধে/ শেষ গানে তার কান্না কেঁদে,/ নীরব যিনি তাঁহার পায়ে/ নীরব বীণা দিব ধরি।’ (গীতাঞ্জলি- ৪৭)।

০২. ‘তারে যখন আঘাত লাগে,/ বাজে যখন সুরে-/ সবার চেয়ে বড়ো যে গান/ সে রয় বহু দূরে।’ (গীতাঞ্জলি- ১৫৬)।

এমন অনেক গান আছে, যেখানে গান আর শুধু গান হয়ে থাকে না; হয়ে ওঠে একটি অধ্যায়। যা শ্রোতাকে করে তোলে চিন্তাশীল। কখনো বা একটি ছোট্ট গান হয়ে ওঠে গান বিষয়ক বিঘত প্রবন্ধ। গানের সাথেই যেন গানের গলাগলি।

বিশ্বভারতী থেকে যখন রচানাবলি বের হয় তখন তার অবতারণিকা লিখবার সময়ও রবীন্দ্রনাথ গানের প্রসঙ্গ আনতে ভুলেননি। বলতে গেলে গানের স্বরূপ অনেকাংশে এখানে উন্মোচিত হয়েছে। একটি গান কখন গান থাকে আর কখন গানের খোলস ছেড়ে পালায়, তা বলেছেন এখানে। কবি বলেছেন

—‘গানের লয় মিষ্টি লাগে যখন কানের সজীব ছন্দ মেনে চলে। তাকে দুন থেকে চৌদুনে চড়ালে সে কলাদেহ ছেড়ে কৌশলদেহ নেবার জন্যই হাঁসফাঁস করতে থাকে।’
(রচনাবলী- ১ (বিশ্বভারতী); অবতারণিতা)।


একই প্রসঙ্গে অন্যস্থানে রবীন্দ্রনাথ গানের বৈশিষ্ট্যের ভিন্নমাত্রা দান করেছেন। কবি বলেছেন—

‘যা আছে কেবলমাত্র তারই বোঝা নিয়ে ঝগড়া চলে, যা নেই তারই আশা নিয়েই গান।’
(লিপিকা-সং; কথিকা)।



‘গান যে গায় গান তারই। গানটা আমার কি তোমার, এই অত্যন্ত বাজে প্রশ্ন যদি না ভুলিয়ে দিলে তাহলে সে গান গানই নয়।’ (তপতী-৩)।

বাংলা গানের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ‘ছন্দ’ গ্রন্থে সংস্কৃত ও হিন্দি গানের সাথে বাংলা গানের তুলনা করেছেন। ছন্দের আলোচনাকে পাঠকের কাছে সহজবোধ্য করবার জন্যে লেখক গানের চেয়ে সহজ পথ অন্য কারো মাঝে খুঁজে পাননি। কারণ, গানের সাধনায় সিদ্ধ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কাছে, গান দিয়ে কঠিন কোনো বস্তু যত সহজে বুঝাতে পারা যাবে, অন্যকিছু দিয়ে তা বোঝানো হয়তো অতটা সহজ হবে না। গানের সুবিধা এই যে, কথাতে কিছুটা অস্পষ্টতা থাকলেও তা সুরের মাধ্যমে উতরানো যায়। তাছাড়া, কবিতার সঙ্গে গানের কোনো বিরোধ নেই। সকল ভালো গানই এক-একটি কবিতা। কাবিতায় যেটা ছন্দ, সঙ্গীতে সেটাই লয়। কিন্তু হিন্দি গান এর বিপরীত। রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি বলেছেন এভাবে—‘হিন্দীতে যে সকল ধ্রুপদ খেয়াল প্রভৃতি পদ শোনা যায় তাহার অধিকাংশই কেবলমাত্র গান, একেবারেই কাব্য নহে। কথাকে সামান্য উপলক্ষ্যমাত্র করিয়া সুর শুনানোই হিন্দী গানের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলায় সুরের সাহায্য লইয়া কথার ভাবে শ্রোতাদিগকে মুগ্ধ করাই কবির উদ্দেশ্য। কবির গান, কীর্তন, রামপ্রসাদী গান, বাউল গান প্রভৃতি দেখিলেই ইহার প্রমাণ হইবে। অতএব, কাব্যরচনাই বাংলাগানের মুখ্য উদ্দেশ্য, সুরসংযোগ গৌণ। এই-সকল কারণে বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারে রত্ন যাহা কিছু পাওয়া যায় তাহা গান।’ (ছন্দ। বাংলা শব্দ ও ছন্দ)।

আসলে বাংলা গানের মূল মেজাজ তার সুরে। বাংলা গান সুরপ্রধান। আর এটা বেশি করে স্পষ্ট হয় অন্যভাষার গানের সাথে এর তুলনা করলে। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বাংলা গান ও বিলাতি গানের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন—‘আমাদের দেশে যাহারা প্রকৃত শ্রোতা গানটাকে শুনিলেই সন্তুষ্ট থাকে, য়ুরোপে শ্রোতারা গান গাওয়াটাকে শোনে।’ (জীবনস্মৃতি। বিলাতি সঙ্গীত) ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তাঁর আত্মজীবনীতে ইউরোপের সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ঠিক এমনটিই বলেছেন (আমার কথা)।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর সকল জটিলতার সহজ সমাধান যেন সহজেই পেয়ে যান গানের মধ্যে, তাঁর গানের সত্তার মধ্যে। পৃথিবী সৃষ্টির আদি রহস্যের যে গভীরতম বেদনাবেগ, তা কবি অনুভব করতে পারেন গান শোনার মধ্য দিয়ে। এ মানব জন্মে কবি মহা কৃতজ্ঞ স্রষ্টার কাছে। তাই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলেছেন—‘পাখিরে দিয়েছ গান, গায় সেই গান,/ তার বেশি করে না সে দান।/ আমারে দিয়েছ স্বর, আমি তার বেশি করি দান,/ আমি গাই গান।’ (বলাকা- ২৮)।

রবীন্দ্রনাথের গান বিষয়ক কথাবার্তার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি বড় গ্রন্থ রচনা করা যাবে, কিন্তু শেষ কি হবে তা? তার পরেও কয়েকটি স্থান এখানে উল্লেখ করতে পারি (যদিও সামান্যই)। যেখানে গানের অনুষঙ্গ এসেছে ওই রচনার স্বার্থে কিংবা পাঠকের স্বার্থে কিংবা রচকের নিজের আত্মতৃপ্তির স্বার্থে। যেমন—উত্সর্গ-৩৫, উত্সর্গ—সংযোজন-২, ৩, গানভঙ্গ (কাহিনী), নবীন, বেদনার লীলা (পূরবী), গানের বাসা (পুনশ্চ), ফাল্গুনী-৩য় দৃশ্য, বন্দিনী (মহুয়া), মানুষের ধর্ম, রাজা-৪, বাঁশিওয়ালা (শ্যামলী), শেষ সপ্তক-সতের, প্রাণের রস (শ্যামলী), শোধবোধ-১ম দৃশ্য, আর্যগাথা (আধুনিক সাহিত্য), বাতায়নিকের পত্র-১ (কালান্তর), সংগীত (পথের সঞ্চয়), ছবির অঙ্গ (পরিচয়), পারস্যে-৭ সহ আরো অনেক স্থানে গান বিষয়ক আলোচনা আছে।

সত্যকথা বলতে কি, রবীন্দ্রনাথের শিল্পসত্তার সমস্ত অংশ জুড়েই যেন থেকেছে গানের অনুষঙ্গ। কখনো রূপে কখনো অরূপে। অর্থাত্ চেতনে বা অবচেতনে গান রবীন্দ্রনাথকে কিংবা রবীন্দ্রনাথ গানকে ছেড়ে দূরে থাকতে পারেননি। আসলে গান মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিও। রক্তমজ্জায় সুরের লহরী সারাক্ষণ। মানুষ আনন্দে গান গায়, কষ্টেও গান গায়। বিপদে হালকা থাকবার জন্যেও গান গায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও হয়তো তার শিল্পসত্তার ভারকে হালকা করবার জন্যে, কিংবা হালকা করে বোঝাবার জন্যে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই গানের সহচারী হয়েছেন সজ্ঞানেই। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংগীতের সিদ্ধপুরুষ।

লেখকঃ মঈন শেখ, বাংলাদেশ।

0 comments