Monday 6 June 2016

জামাইষষ্ঠী - বঙ্গজীবনের অঙ্গ


মানবজীবনে বিভিন্ন সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে দুনিয়া জুড়ে বিশেষ বিশেষ দিন পালন করতে দেখা যায়। যার ফলে মাতৃ দিবস, পিতৃ দিবস , শিশু দিবস, শিক্ষক দিবস সহ নানা রকম দিবস উৎযাপনের কথা শোনা যায়। একেবারে সেই ভাবে না এলেও ভারতে বিশেষত বাংলায় কন্যার স্বামী অর্থাৎ জামাতাকে ভিত্তি করে কোনও একটি বিশেষ দিন পালনের রেওয়াজ রয়েছে৷জামাইয়ের মঙ্গলকামনায় মূলত শাশুড়িরা বছরের একটি বিশেষ দিন পালন করে থাকে৷ এটি একটি সামাজিক প্রথা যাকে জামাইষষ্ঠী বলে পরিচিত। অন্য ভাবে দেখতে গেলে জামাইষষ্ঠী একটি লোকায়ত প্রথা৷ ষষ্ঠীদেবীর পার্বণ থেকে এর উদ্ভব৷ বৈদিক সমাজেও জামাইষষ্ঠী হত বলে শোনা যায়৷

আধুনিকতার দিকে যতই এগোন যাক না কেন, বাঙালি জীবনের আচার অনুষ্ঠান একে বারে উঠে গিয়েছে তা বোধহয় বলা উচিত নয়৷ একেবারে সেকেলে অবস্থা না থাকলেও নতুন আঙ্গিকে পুরনো আচার অনুষ্ঠান হাজির থাকছে এখনও বঙ্গজীবনে৷তাই গ্রামের পাশাপাশি ও শহরাঞ্চলেও জামাই ষষ্ঠী পালনের রেওয়াজটা চলে আসছে ৷তবে বলা যেতে পারে নগর জীবনে এই দিনটি পালনে কিছুটা বিবর্তন এসেছে৷ যেমন এ যুগের কর্মরত ব্যস্ত শাশুড়িরা নিজের হাতে রান্না করে জামাইকে খাওয়াতে পারছেন না, তাই বলে জামাইষষ্ঠী হচ্ছে না তা নয় ৷ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাড়ির বদলে হোটেল রেস্তরাঁয় জামাইষষ্ঠীর আয়োজন করে শাশুড়ি তাঁর কর্তব্য সারছেন৷ যদিও এ নিয়েও নিন্দুকেরা খুঁত ধরেন আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলে৷ তবে এমন ব্যবস্থায় খুশি জামাইবাবাজীরাও ৷ আগের মতো রয়ে বসা থাকার দিন নেই, জীবনের গতি বেড়েছে ফলে নিজ নিজ পেশায় টিকে থাকতে তারাও কর্মে মুক্তি খোঁজেন৷ফলে সারাদিনটা শ্বশুরবাড়ীতে নষ্ট করতে রাজী নন একালের জামাইরাও৷ 

এই দিনটি পালনে পরিবর্তন এলেও একটু পিছন ফিরে তাকালে আঁচ করা যায় জামাইষষ্ঠী পালনের মাহাত্ম ৷প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা প্রথম প্রহরে মা ষষ্ঠীর পূজার আয়োজন করে থাকে। দেবী ষষ্ঠীর প্রতিমা কিংবা আঁকা ছবিকে পূজা করা হয়। কেউ কেউ অবশ্য ঘট স্থাপন করেও এই পূজা সারেন। ষষ্ঠীদেবী হলেন মাতৃত্বের প্রতীক৷তিনি আবার দ্বিভুজা, দুনয়না, গৌরবর্ণা, দিব্যবসনা, সর্বসুলক্ষণা ও জগদ্ধাত্রী শুভপ্রদা। বিড়াল হল তাঁর বাহন। ষষ্ঠীপূজার উদ্দেশ্য হল সন্তানের কল্যাণ ও সংসারের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা। ষষ্ঠী পূজার নিময় অনুসারে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য পৃথক মালসার মধ্যে নতুন বস্ত্র, ফলফলাদি, পান-সুপারি, ধান-দূর্বা ও তালের পাখা রাখা হয়। ভক্তরা উপোস করে মায়ের পূজা সারেন। মালসা থেকে নতুন বস্ত্র পরিধান করে ফলফলাদি খেতে হয়। আবার ঘর ও মন্দিরের বাইরে বট, করমচার ডাল পুঁতে প্রতীকী অর্থে অরণ্য রচনা করে এ পূজা করা হয়। এজন্য জামাই ষষ্ঠীকে অরণ্য ষষ্ঠীও বলা যায়। পরবর্তীকালে এ পূজায় ধর্মীয় সংস্কারের চেয়ে সামাজিকতা বিশেষ স্থান পেয়েছে।

আবার বলা হয়ে থাকে এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হল কন্যার সন্তান উৎপাদনের জন্য শাশুড়ি কর্তৃক জামাইকে অভিনন্দন জানানো অথবা সেই কাজের জন্য উৎসাহিত করে জামাইয়ের দীর্ঘজীবন কামনা করা। ফলে ষষ্ঠী পূজায় উপবাস করা ব্রতীরা সকালে স্নান করে আম্রপল্লব, আমসহ পাঁচফল আর ১০৮টি দুর্বাবাঁধা আঁটি দিয়ে পূজার উপকরণ সাজান। এক্ষেত্রে ধান সমৃদ্ধির প্রতীক এবং বহু সন্তানের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়৷ তাছাড়া দুর্বা চিরসবুজ ও দীর্ঘ জীবনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই এমন দিনে শাশুড়ি মেয়ে-জামাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে ধানদুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করেন৷
এই বিষয়ে মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার অন্য একটি ব্যাখ্যাও শোনা যায়৷পুত্র যেমন পিতার আত্মজ, কন্যা তেমনি জননীর আত্মজা৷মানে পুত্রের মাধ্যমে যেমন পিতার পিতৃত্বের ধারা অক্ষুণ্ণ থাকে তেমনি কন্যার মাধ্যমে মাতার জননীত্বের ধারা অক্ষুণ্ণ থাকে৷ অর্থাৎ মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার এক ধারা এই জামাইষষ্ঠী পালনে নিহিত বয়েছে বলেও ব্যাখ্যা শোনা যায় ৷

এই প্রসঙ্গে একটি লোককথার উল্লেখ করতে হয়৷ কথিত আছে, জনৈক গৃহবধূ শ্বশুরবাড়িতে থাকাকালীন মাছ চুরি করে খেয়ে বারবার বিড়ালের ওপর দোষ দিতেন। এরপর একদিন তার সন্তান হারিয়ে যায়৷ তখন পাপের ফল ভেবে সন্তান ফিরে পেতে সে বনে গিয়ে দেবী ষষ্ঠীর আরাধনা শুরু করে। ওই গৃহবধূর আরাধনায় মা ষষ্ঠী সন্তুষ্ট হলে সেই বনে সন্তান ফিরে পায়। এই জন্যই নাকি ষষ্ঠীদেবীর অন্য নাম অরণ্যষষ্ঠী। এদিকে মাছ চুরি করে খাওয়ার অপরাধে গৃহবধূর শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে ওই গৃহবধূর মা-বাবা তাঁদের মেয়েকে দেখতে একবার ষষ্ঠীপূজার আয়োজন করে এবং সেই পুজোর দিন শ্বশুরবাড়িতে আসার জন্য জামাইকে নিমন্ত্রণ করেন। এরপর সেই পুজো উপলক্ষ্যে সস্ত্রীক জামাই হাজির হলে মেয়েকে দেখে তার মা-বাবার মনে আনন্দ আর ধরে না৷ ৷ষষ্ঠী পুজো ঘিরে এমন ঘটনা ঘটায় বাঙালি হিন্দুসমাজে এক নতুন উৎসবের সূচনা হয়৷ কার্যত ষষ্ঠী পুজো রূপান্তরিত হয় সামাজিক অনুষ্ঠান জামাইষষ্ঠীতে ৷ ফলে যে পরিবারে সদ্যোবিবাহিতা কন্যা আছে, সে পরিবারে এ পার্বণটি ঘটা করে পালন করা হয়ে থাকে।

পাশাপাশি মনে রাখা উচিত বাঙালি সমাজের এই উৎসবের পিছনে একটি আর্থ সামাজিক অবস্থা লুকিয়ে রয়েছে৷ প্রবাদ রয়েছে, যম-জামাই ভাগনা-কেউ নয় আপনা। কারণ যম মানুষের মৃত্যু দূত। অন্যদিকে জামাই এবং ভাগনা অন্যের বাড়ির উত্তরাধিকারী। সেক্ষেত্রে তাদের কখনও নিজের বলে দাবি করা যায় না। এদের খুশি করার জন্য মাঝে মাঝেই আদর আপ্যায়ন করা উচিত বলে মনে করা হত৷ কারণ জামাই খুশি থাকলে শ্বশুর বাড়িতে মেয়ে ভাল থাকবে বলে আশা করা হত ৷ তাই গরমকালে জামাইকে একটু ডেকে এনে আম-দুধ খাইয়ে পরিতৃপ্ত করা এবং আশীর্বাদস্বরূপ উপহারসামগ্রীও প্রদান করার প্রথা চালু হয় বলে মনে করা হয়৷অর্থাৎ এই দিনটি পালনের মাধ্যমে মেয়ের বাবা-মা জামাইকে এক ধরনের ঘুষ দিয়ে কন্যা সন্তানের সুখ কিনত বলেও নানা মহলের ধারণা৷

বিগত কয়েক দশক ধরে ভাঙছে একান্তবর্তী পরিবার৷ নারীশিক্ষার প্রসার ঘটছে – কাজের জন্য বাইরে পা রেখেছে মেয়েরা৷ ধীরে ধীরে প্রকৃত অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে মেয়েরা৷ তাই আগের মতো আজ আর বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য কোনও ছুতো খুঁজতে হয় না মেয়েদের ৷শুধু জামাইষষ্ঠী কেন যে কোনও দিনই চাইলে এখন বিবাহিত মেয়েরা একবার বাবা -মাকে দেখে আসতে পারে ৷ শুধু তাই নয় কোনও কোনও ক্ষেত্রে কন্যা সন্তানই তাদের বৃদ্ধ বাবা মায়ের দেখা শোনার ভার তুলে নিচ্ছে৷সেক্ষেত্রে কন্যার গৃহে থাকার সুবাদে তো প্রতিদিনই জামাইবাবাজির দর্শন পাচ্ছেন শাশুড়ি মা৷ যা দেখে কেউ কেউ মনে করেন জামাইষষ্ঠী প্রথাটাই আজ অপ্রাসঙ্গিক ৷ কিন্তু প্রতিদিন জামাই দর্শন হলেও তার মধ্য থেকেই একটা বিশেষ দিনে জামাইকে একটু আলাদা করে দেখতে চাওয়ার শখ তো কোন শাশুড়ী মায়ের হতে পারে ৷তার আগের প্রজন্মের মানুষেরা যা শিখিয়েছেন স্থান, কাল, পাত্র বদলে গেলেও তিনি যদি নতুন আঙ্গিকে সেই ধারারাহিকতা বজায় রাখতে চান তাহলে বঙ্গজীবনে জামাইষষ্ঠী রয়ে যাবে৷

0 comments