Sunday 12 June 2016

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের উক্তি [পর্ব ১]


শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের উক্তি
সংকলন—গিরিশচন্দ্র সেন

১. মত সম্পর্কে তর্ক করা উচিত নয়?
উঃ তর্ক করা অপ্রয়োজন। তুমি তোমার মতের উপর নির্ভর করিয়া থাক, অন্যকেও তাহার মতের উপর নির্ভর করিয়া থাকিতে দাও। বৃথা তর্কে কোনো ফল নাই। যখন ঈশ্বরের কৃপা হইবে, তখন সকলেই আপন আপন ভুল বুঝিতে পারিবে।

২. কীরূপে পবিত্রতা লাভ করিব?
উঃ সরোবরের উপর হইতে ধীরে ধীরে জলপান করিও, তাহা হইলে পরিষ্কার জল পাইবে; যদি আলোড়ন কর, ভিতর হইতে ময়লা নির্গত হইয়া সেই জলকে ঘোলা করিয়া তুলিবে। এইরূপ পবিত্রতা লাভ করিতে চাইলে, তুমি বিশ্বাস সহকারে সাধনায় প্রবৃত্ত থাকো। শাস্ত্রীয় বিচারে নিযুক্ত হইলে বড় গোলে পড়িবে।

৩. বীর সাধক কাহাকে বলে?
উঃ যিনি সংসারের মধ্যে থাকিয়া সাধনা করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ বীর সাধক। বালকেরা যেমন খুঁটি ধরিয়া ঘুরিতে থাকে, পড়িবার ভয় হয় না, সেইরূপ সংসারে ঈশ্বরকে ধরিয়া কার্য করিলে আর বিপদের আশঙ্কা থাকে না।

৪. বিশ্বাসী সাধক কীরূপ?
উঃ সাগরে এক প্রকার শামুক আছে, উহা হাঁ করিয়া জলের উপর ভাসিয়া বেড়ায়, কিন্তু স্বাতী নক্ষত্রের এক বিন্দু জল তাহার মুখে পড়িলে সে অগাধ জলের ভিতর নিমগ্ন হয়, আর উপরে ভাসিয়া উঠে না। বিশ্বাসী সাধকও এইরূপ, গুরুমন্ত্ররূপে এক বিন্দু জল পাইলে সাধনার গভীর জলে ডুবিয়া পড়ে, অন্য কোনো দিকে আর দৃষ্টি করে না।

৫. চতুর লোক কাহাকে বলা হয়?
উঃ দুই ব্যক্তি আমের বাগে প্রবেশ করে। যাহার বিষয়বুদ্ধি প্রবল ছিল, সে সেই বাগের মূল্য কত, তাহাতে কতটা আম গাছ আছে, এক একটি বৃক্ষে কতগুলি আম ফলিয়াছে ইত্যাদি দেখিয়া ও গুণিয়া বেড়ায়। অপর ব্যক্তি উদ্যানস্বামীর সহিত আলাপ করিয়া এক একটি করিয়া আম পাড়িয়া ভক্ষণ করিতে থাকে। বল দেখি, কোন ব্যক্তি চতুর? গাছ ও পাতা গুণিয়া হিসাব কিতাব করিলে কী হইবে? আম খাও, পেট ভরিবে। যাহাদের জ্ঞানাভিমান আছে, তাহারা যুক্তি, তর্ক, মীমাংসা ও শাস্ত্রীয় বচন লইয়া বিব্রত হইতে থাকে। চতুর লোক ঈশ্বরের সঙ্গে আলাপ করিয়া সংসারে সুখ ভোগ করেন।

৬. সংসারে ভারি ব্যস্ততা, কেমন করিয়া ঈশ্বর প্রাপ্ত হই?
উঃ কুমীর জলের উপর ভাসিতে ভালবাসে, কিন্তু মনুষ্যের তাড়নায় তাগাকে অগাধ জলে ডুবিয়া থাকিতে হয়, তথাপি সময়ে সময়ে সে ভোস করিয়া জলের উপরিভাগে উঠে। সচ্চিদানন্দ সাগরে তোমাদেরও সেইরূপ ভাসিয়া বেড়াইবার বড় সাধ; কিন্তু স্ত্রী-পুত্রাদির অনুরোধে তোমাদিগকে মায়ার অগাধ জলে ডুবিতে হয়। তথাপি সময়ে সময়ে হরিনাম করিও, এবং কাতর প্রাণে তাঁহার নিকটে প্রার্থনা করিয়া দুঃখ জানাইও। যথাসময় শ্রীহরি তোমাদিগকে আশ্রয়দান করিবেন।

৭. সংসারে থাকিয়া কীরূপে সাধন করিতে হইবে?
উঃ এরূপ শুনা যায়, যাহারা শব সাধনা করে, তাহারা সঙ্গে ছোলা মটর জল ইত্যাদি রাখে। শব যখন জাগিয়া হাঁ করিয়া ওঠে, তখন তাহার মুখে সেই সমস্ত খাবার সামগ্রী অর্পণ করে, তাহাতে শব নিস্তব্ধ হইয়া থাকে, নতুবা সাধনায় বিঘ্ন জন্মায়। সংসারে হরি সাধন করিতে হইলে, পূর্বে স্ত্রীপুত্রাদির জন্য সাংসারিক খরচপত্রের ব্যবস্থা করিয়া সাধনায় বসিবে, নতুবা সাধনায় ব্যাঘাত হইবে।

৮. যেরূপ কাজের ব্যস্ততা, কেমন করিয়া সাধন হয়?
উঃ যেমন বাউল দুই হাতে দুই প্রকার বাদ্য বাজাইয়া মুখে গান করে, তুমিও ঈশ্বরেতে মন সঁপিয়া তদ্রূপ কার্যেতে ব্যস্ত থাক।

৯. মনুষ্য একবার নব জীবন লাভ করিলে কি আর বিকৃত হয় না?
উঃ স্পর্শমণির স্পর্শে যে লোহা সোনা হইয়াছে, তাহা জঙ্গলে ও কাদায় ফেলিয়া রাখ, সোনাই থাকিবে, লোহা আর হইবে না। ভগবানের সংস্পর্শে যাহার নবজীবন লাভ হইয়াছে, পৃথিবীর দুঃখ দারিদ্র্য ও নির্যাতনে সে বিকৃত ও অপবিত্র হয় না।

১০. মহাপুরুষেরা কীভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন?
উঃ যেমন বাষ্পীয় শকট গুরুভারবিশিষ্ট দ্রব্য সকল বহন করিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া যায়, মহাপুরুষগণও পৃথিবীর গুরুভার বহন করিয়া দ্রুতগতিতে লক্ষ্যস্থানে গমন করেন।

তথ্যসূত্র: বঙ্গভারতী ব্লগ

0 comments