শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের উক্তি
সংকলন—গিরিশচন্দ্র সেন
উঃ সাগরের জল পান করিলে যেমন তাহাতে লবণ আছে, বুঝিতে পারা যায়, ব্রহ্মাণ্ড দর্শন করিয়াও ব্রহ্মাণ্ডপতির অস্তিত্ব নিশ্চয়ই জানিতে পারা যায়।
১২. ঈশ্বরের রাজ্যে যাইবার এক পথ, না বহু পথ?
উঃ অট্টালিকার ছাদে যেমন মই বাঁশ সিঁড়ি দড়ি প্রভৃতি নানা উপায়ে উঠা যায়, তদ্রুপ ঈশ্বরের রাজ্যে যাইবার সহজ ও কঠিন নানাবিধ উপায় আছে। প্রত্যেক ধর্মশাস্ত্রে এক এক প্রকার উপায় প্রদর্শিত আছে।
১৩. যাঁহার নিকট কিছু শিক্ষা করা যায়, তাঁহাকে গুরু না বলিয়া, এক জন বিশেষ ব্যক্তিকে গুরু বলিবার আবশ্যকতা কী?
উঃ গুরু একজন; কিন্তু উপগুরু অনেক হইতে পারেন, যাঁহার নিকটে যে জন কিছু শিক্ষা লাভ করে, তিনিই তাঁহার উপগুরু।
১৪. কীরূপে ধ্যান ধারণ করিতে হইবে?
উঃ মাঠের উপর দিয়া ঢাক ঢোল বাজাইয়া মহা ঘটা করিয়া বর যাইতেছিল, তখন এক পার্শ্বে এক জন স্থির শান্তমনে আপনার লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি করিয়া রহিয়াছে। এমন যে বাদ্যোদ্যম ও সমারোহ, তৎপ্রতি তাহার ভ্রুক্ষেপও নাই। ব্যাকুল অন্তরে চাহিয়া রহিয়াছিল, পাখিটিবা পাছে উড়িয়া যায়। এই রূপে ব্রহ্ম ধ্যান করিতে হইবে। একটি বক ধীরে ধীরে মাছ ধরিতে যাইতেছে, এদিকে ব্যাধ বককে বাণ বিঁধিতে উদ্যত, বক সে দিকে তাকাইতেছে না। এইরূপে লক্ষ্য স্থির করিয়া ধ্যান করিবে।
১৫. কীরূপে এই সংসারের বিপদ পরীক্ষায় শান্তি লাভ করা যায়?
উঃ এক চিল একটি মাছ মুখে করিয়া যাইতেছিল, শত শত কাক সেই মাছটি কাড়িয়া লইবার জন্য চিৎকার করিয়া তাহার পিছনে দৌড়িল। কিছু পরে সে বিরক্ত হইয়া মাছ ফেলিয়া দিল, এবং একটি গাছের উপর যাইয়া শান্তভাবে বসিল। আর একটি চিল তাহা লইয়া প্রস্থান করিল, উহার পশ্চাতে কাক চিল সকল ধাবিত হইল। এইরূপ লঘুভার ব্যক্তিই সংসারে শান্তি লাভ করে। তাহা না হইলে মহাবিপদ।
১৬. পুণ্যাত্মা ধার্মিকদের মনে কি সময়ে সময়ে নিরাশা ও অবিশ্বাসের রেখা পড়ে না?
উঃ যেমন পদ্মানদীর স্রোত প্রবলবেগে চলিতে চলিতে এক এক স্থানে ঘূর্ণায়মান হয়, কিন্তু পরক্ষণেই আবার সোজা হইয়া চলিয়া যায়, তদ্রুপ সাধু মহাত্মাদের মনেও কখনও কখনও নিরাশা ও সন্দেহের রেখা পড়ে, কিন্তু তাহা থাকে না, অচিরে বিদূরিত হয়।
১৭. সংসারমুগ্ধ লোকে কেমন করিয়া তাঁহাকে পাইবে?
উঃ শিশু ছেলে যেমন লাল চুষি পাইয়া তাহাতে ভুলিয়া থাকে, যখন সে চুষি ফেলিয়া মা বলিয়া চেঁচাইয়া ওঠে, তখন মা তাহার নিকটে আসেন ও তাহাকে বুকে করিয়া স্তন্য দান করেন। এইরূপ সংসারে অনেক চকচকে সামগ্রী আছে লোকে ছেলেমানুষের ন্যায় তাহা পাইয়া ঈশ্বরকে ভুলিয়া থাকে, তাহা ফেলিয়া ভগবানকে কাতরপ্রাণে ডাকিলেই তাঁহাকে প্রাপ্ত হয়।
১৮. চিরকালের পাপী কি হঠাৎ সাধু হইতে পারে?
উঃ একটি গৃহে শত বৎসর ব্যাপিয়া অন্ধকার থাকিলেও প্রদীপের আলোকে যেমন হঠাৎ সেই অন্ধকার বিদূরিত হয়, তদ্রুপ বহু কালের পাপীর মনও ঈশ্বরকৃপার আলোকে হঠাৎ শুদ্ধ হইতে পারে।
১৯. ঈশ্বরোপাসনা করিয়াও তো অনেক মানুষ ভাল হয় না?
উঃ আমড়ার অম্বলস্বরূপ কামিনী কাঞ্চনে এখনও যাহার সাধ রহিয়াছে, সে জীবন পরিবর্তনের সংকল্প না করিলে শুদ্ধ উপাসনায় তাহার কী হইবে? কিন্তু যথার্থ মুক্তির প্রার্থী ব্যক্তি বলেন, ‘আমি ঈশ্বরকৃপায় এই মুহুর্তে ভাল হইব।’ বাস্তবিক সে ভাল হয়।
২০. স্বার্থপরতা অহঙ্কারাদি কি শীঘ্র দূর হয় না?
উঃ সাগরগর্ভে লুক্কাইত চুম্বক যেমন নিকটস্থ জাহাজের সমুদায় লৌহ পেরেক টানিয়া বাহির করে, তাহাতে জাহাজখানা খণ্ড খণ্ড হইয়া জলমগ্ন হয়। তদ্রুপ জ্ঞানসূর্যের উদয় হইলে, স্বার্থ-অহংকার-পূর্ণ জীবন ক্ষণকাল মধ্যে ভাঙিয়া যায়।
0 comments