Tuesday, 31 May 2016

দোলযাত্রা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

দোলযাত্রা

হিন্দু শাস্ত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশ প্রকার যাত্রার কথা বিধৃত রয়েছে। তার মধ্যে দোলযাত্রা অন্যতম। আগামী ৫ মার্চ এদেশে হিন্দু সম্প্রদায় এই উত্সব পালন করবেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আগমনের কোন কোনটি যাত্রা হিসেবে বর্ণিত, যেমন—ঝুলনযাত্রা, রথযাত্রা, রাসযাত্রা ইত্যাদি। আবার, কোন কোনটিতে যাত্রা উল্লেখিত থাকে না, যেমন—জন্মাষ্টমী। ভগবান যখন মন্দির থেকে ভক্তগণের মধ্যে নেমে আসেন, তখন তাকে বলে যাত্রা।

সনাতন ধর্মে প্রায় প্রতিটি উত্সব প্রকৃতি সম্বন্ধীয়। কেননা, নিরাকার—নিরাবয়ব পরব্রহ্ম যখন ভক্তের আকিঞ্চনে এক থেকে বহু হতে চাইলেন, তখন তিনি সাকারে প্রকাশিত হলেন। প্রথমেই তিনি পুরুষ ও প্রকৃতিতে বিভাজিত হলেন। এই পুরুষই আবার ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব রূপে বিশ্বচরাচর সৃজন-পালন ও প্রলয় করছেন। আর, প্রকৃতি সেই সৃষ্টির আদিশক্তি বা আদ্যাশক্তি। এই অখণ্ড আদ্যাশক্তিই জগতে ক্রিয়াশীলা রয়েছেন। তিনিই নানারূপে প্রকাশিতা হন। তিনিই সমরে সিংহবাহিনী, ভোগে ভবানী, জগত্পালনে জগদ্ধাত্রী, অসুর নিধনে করালী কালী, সম্পদে লক্ষ্মী, জ্ঞানে সরস্বতী। আবার পুরাণে তিনি হ্লাদিনী শক্তিরূপে বর্ণিতা। শক্তিমানের শক্তি তিনি, তিনিই বিশ্ববিধাত্রী। শক্তি ছাড়া শক্তিমান হয় না এবং শক্তিমান ছাড়া শক্তি থাকে না। একের মধ্যে দুই—দু’য়ে মিলে এক। একের মধ্যে বহু, বহু মিলে এক। সুতরাং, শক্তিমানের সাথে তার শক্তি মিলিত হতে চাইবে সেটাইতো স্বাভাবিক। প্রকৃতির প্রধান দৈবীশক্তি বা দেবতা—সূর্য। সূর্যের তথা প্রকৃতির দোলাচল বা গতাগতি দৃষ্টে দুটি উত্সব বা যাত্রা আখ্যায়িত। যথা : ঝুলনযাত্রা ও দোলযাত্রা। এ দুটি যাত্রা দুটি অয়ন-এর প্রারম্ভিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়। যথা : দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ণ। কাল বিভাজনে বছর একটি ইউনিট হিসেবে বিভাজিত। বছরের শ্রাবণ থেকে পৌষ- এ ছয় মাস হলো দক্ষিণায়ন (যখন সূর্য পৃথিবীর বিষুব রেখার দক্ষিণ অয়ন বা দিকে লম্বভাবে কিরণপাত করে) এবং মাঘ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত ছয় মাস উত্তরায়ণ (যখন সূর্য বিষুব রেখার উত্তরদিকে লম্বভাবে বা খাড়াখাড়িভাবে কিরণপাত করে)। শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষীয় একাদশী তিথি থেকে পূর্ণিমাতে হয় ঝুলনযাত্রা এবং ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমাতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ঝুলনযাত্রায় আহ্নিকগতির নিয়মে সূর্যের পূর্ব-পশ্চিমে গতাগতি নিরিখে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকাকে পূর্বদিকে মুখ করে ঝুলনমঞ্চে বসিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে দোল দেয়া হয়। আর, বার্ষিক গতির নিয়মে সূর্যের বছরে একবার দক্ষিণদিক থেকে উত্তরদিকে এবং একবার উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে গতাগতি নিরিখে ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকাকে দক্ষিণমুখ করে দোলমঞ্চে বসিয়ে উত্তর-দক্ষিণে দোল দেয়া হয়।

প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, এ সময়েই বসন্ত উত্সব হয়, হোলি উত্সব বা রং খেলা যার প্রধান আকর্ষণ। এর সাথে মহাপুণ্য আর একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে, তাহলো মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব-এর আবির্ভাব তিথি। তাই, এ ফাল্গুনী পূর্ণিমায় উদ্যাপিত হয় দোলযাত্রা (দোলপূর্ণিমা), গৌর পূর্ণিমা, বসন্ত উত্সব (হোলি উত্সব) ইত্যাদি।

শীতের রুক্ষতা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় তথা ঋতু পরিবর্তনের প্রভাবে এ সময়ে মানবদেহে রক্তের ৩টি উপাদান-আয়রন, ক্যালসিয়াম ও মার্কারির অভাব ঘটে বলেই দুর্বল দেহে চর্মরোগের তথা একটি বিশেষ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে যা কালক্রমে ‘বসন্ত রোগ’ নামে খ্যাত হয়েছে। তত্কালে, আধুনিক চিকিত্সা ছিল না বলেই প্রতিরোধক হিসেবে আবীর গায়ে মাখানো হতো। আবীরে তথা লাল রং-এ উক্ত তিনটি উপাদান বিদ্যমান থাকে। নিজের গায়ে নিজে অনেক সময় রং মাখতে অসুবিধা হয় বলে একে অপরের গায়ে রং মাখানোর বিষয়টি চালু হয়। কালক্রমে আনন্দ ও হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে রং দেয়া বা মাখানোর রীতিতে পরিণত হয়, যা হোলি খেলা উত্সব হিসেবে প্রচলিত হয়ে আছে। আর, এতে দিনে দিনে যুক্ত হতে থাকে নানা আনুষ্ঠানিকতা যা বসন্ত উত্সব নামে প্রচলিত হয়ে চলছে। কালপ্রবাহে কখনও পঞ্চমীতে, কখনও একাদশীতে, আবার কখনও পূর্ণিমাতে বসন্তোত্সব হতো।

0 comments