স্বগৃহে ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ নাটকে বাল্মীকির বেশে রবীন্দ্রনাথ |
অ্যাভনের রাজহংসের মতো জোড়াসাঁকোর রবিও ছিলেন একাধারে সফল কবি ও সার্থক নাট্যকার। রবীন্দ্রনাথের নাটক প্রচলিত প্রথার অনুগামী নয়। বরং স্বকীয় জীবনচেতনার অঙ্গীরসে জারিত এই নাটকগুলি তাঁর শিল্পীসত্ত্বার আত্মপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ইউরোপীয় ভাবপ্রভাবে একটি নতুন নাট্যচেতনা বিকাশলাভ করেছিল ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গনে। এই ভাবে দীক্ষিত হয়েছিলেন সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথও। তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে নব নব সৃষ্টিলীলায় বাংলা নাট্যসাহিত্যে অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য এনেছিলেন তিনি। এই বৈচিত্র্য শুধু বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধই করেনি, বরং ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে’ মজে থাকা রাঢ় ও বঙ্গের যুগরুচি সংস্কারে, এবং তা বিশ্বমননের উপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
রবীন্দ্রনাথের মৌলিক নাটকের সংখ্যা ৩৮। এই নাটকগুলিকে কয়েকটি বর্গে বিভক্ত করা যায়। যেমন: গীতিনাট্য, নিয়মানুগ নাটক, কাব্যনাট্য, নৃত্যনাট্য, প্রহসন-কৌতুকনাট্য ও রূপক-সাংকেতিক নাটক।
নাট্যমঞ্চে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব তাঁর গীতিনাট্যের হাত ধরে। এই নাটকগুলিতে রবীন্দ্রনাথের সুরস্রষ্টা (composer) ও নাট্যকার প্রতিভার যুগপৎ সমাহার লক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রথম সৃষ্টি ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ (১৮৮১) ও ‘কালমৃগয়া’ (১৮৮২)। দু’টি নাটকই কৃত্তিবাসী রামায়ণের দু’টি পৃথক কাহিনি অবলম্বনে রচিত। এই দু’টি নাটক এবং ‘মায়ার খেলা’ (১৮৮৮) রবীন্দ্রনাথের বিশুদ্ধ গীতিনাট্যের উদাহরণ। উল্লেখ্য, ‘মায়ার খেলা’র আখ্যানভাগ রবীন্দ্রনাথের স্বকল্পিত। এই নাটকে সংগীতের জালে বাঁধা পড়েছে এক জটিল প্রেমের কাহিনি।
রবীন্দ্র-গীতিনাট্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য গীতিপ্রাণতা। নাটকের সংলাপগুলি সবই গানে বাঁধা। ইতালীয় অপেরা ও আইরিশ মেলোডিজ এই গানগুলির অনুপ্রেরণা। আর এক অনুপ্রেরণা দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গান ও সুর। নিজের আত্মকথাতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অবশ্য এও দাবি করেছেন যে, ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’র সুরকার তিনিই। সে যাই হোক, জীবনপ্রভাতের গীতিনাট্যের মাধ্যমে যে বীজ রবীন্দ্রনাথ রোপণ করেছিলেন, তার পরিপক্ক ফসল জীবনসায়াহ্নের নৃত্যনাট্য। আর গানকে তো সারা জীবনই রবীন্দ্রনাথ নাটকের অপরিহার্য অঙ্গ মনে করেছেন।
প্রায় একই সময়ে গীতিপ্রাণতা থেকে কিছুটা মুক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রথানুগ অর্থাৎ শেকসপিয়রীয় পঞ্চাঙ্ক রীতির নাট্যরচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। এই ধারার ‘রাজা ও রাণী’ (১৮৮৯) নাটকটিকে তিনি বাস্তবানুগ করে তুলতে চেয়েছিলেন। যদিও কৃত্রিমতা ও অতিরঞ্জন দোষ এটিকে শেষমেষ পর্যবসিত করে মেলোড্রামায়। গীতিপ্রাণতাকে প্রতিহত করলেও গদ্যনাট্যে কাব্যের উচ্ছ্বাস রোধ করতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সমালোচককে উদ্ধৃত তিনি নিজেও স্বীকার করেছিলেন, “কেহ বলে ‘ড্রামাটিক’/ বলা নাহি যায় ঠিক/ লীরিকের বড় বাড়াবাড়ি।”
যদিও এই বর্গের ‘বিসর্জন’ (১৮৯০) নাটকটি নিজ প্রসাদগুণে ভাস্বর। প্রথা ও হৃদয়ের দ্বন্দ্ব, চরিত্র ও ঘটনার সংঘাত ও শেকসপিয়র-সুলভ মানবচেতনা এখানে বহুলাংশে লক্ষিত হয়। এই বর্গের অন্যান্য নাটকগুলির মধ্যে প্রায়শ্চিত্ত (১৯০৯), ‘গৃহপ্রবেশ’ (১৯২৫) ও ‘তপতী’ (১৯২৯) উল্লেখযোগ্য।
উনিশ দশকের শেষ দশকে রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে উৎসারিত হয় অনেকগুলি কাব্যনাট্য ও নাট্যকবিতা – ‘সতী’ (১৮৯২), ‘বিদায় অভিশাপ’ (১৮৯৩), ‘মালিনী’ (১৮৯৬), ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৮৯৭), ‘গান্ধারীর আবেদন’ (১৮৯৭), ‘নরকবাস’ (১৮৯৭), ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ (১৮৯৭), ‘কর্ণকুন্তীসংবাদ’ (১৯০০) ইত্যাদি। ‘চিত্রাঙ্গদা’ আলোচনাকালে অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যে উক্তিটি করেছেন, তা এই নাট্যবর্গের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলির দ্যোতক: “মনস্তত্ত্ব ও হৃদয়ের সংঘাতের ইঙ্গিত এই নাট্যপ্লাবনের নীচে চাপা পড়িয়া গিয়াছে, কিন্তু অন্তরাত্মা কাব্যের।” আসলে, গীতিধর্ম ও ভাবতত্ত্বরূপায়ণের ঝোঁকে শেকসপিয়র-অতৃপ্ত কবি প্রবৃত্ত হয়েছিলেন ঘটনাবিন্যাস-বিবর্জিত কাব্যালঙ্কার-শোভিত নাট্যবস্তু পরিবেশনে। তারই ফসল এই বর্গের নাটকগুলি।
প্রায় একই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঝোঁকেন হাস্যরসাত্মক নাটকের প্রতি। এগুলি প্রহসন। কিন্তু একটু ভিন্ন প্রকৃতির। ‘গোড়ায় গলদ’ (১৮৯২), ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ (১৮৯৭), ‘চিরকুমার সভা’ (১৯২৬), ‘শোধবোধ’ (১৯২৬) ও ‘শেষরক্ষা’ (১৯২৮) – এগুলি কেবল জনচিত্তরঞ্জনকারী লঘু হাস্যরসাত্মক নাটক ছিল না। কিছু খামখেয়ালি চরিত্রের স্বভাবগত অসংগতিটিকে রবীন্দ্রনাথ এই সব নাটকে হাসির খোরাক করেছেন। কিন্তু তা হয়েছে মার্জিত ভাবে, নির্মল হাস্যরস পরিবেশনের মাধ্যমে।
তবে রবীন্দ্র নাট্য-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম ধারাটি হল তাঁর ‘রূপক-সাংকেতিক’ নাটকের ধারা। শাখাটির বিকাশ শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের কাব্যজীবনের ‘গীতাঞ্জলি’-পর্বে। সমকালীন ইউরোপীয় নাট্যসাহিত্যের রূপক-সাংকেতিক ধারার প্রভাবে, বিশেষত বেলজিয়ান নাট্যকার মেটারলিংক ও নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের প্রতীকী নাট্যশৈলী ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রধান অনুপ্রেরণা। ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮), ‘রাজা’ (১৯১০), ‘ডাকঘর’ (১৯১২), ‘অচলায়তন’ (১৯১২), ‘ফাল্গুনী’ (১৯১৬), ‘মুক্তধারা’ (১৯২২), ‘রক্তকরবী’ (১৯২৬) – এই বর্গের প্রধান নাটক।
এতদিন যে বৈশিষ্ট্যগুলি নানা বর্গে বিভক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথের নানা নাটকে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই গীতিধর্মিতা, কাব্যশোভা, ঘটনাবিন্যাসের নৈপাট্য, ভাবতত্ত্বরূপায়ণ, চারিত্রিক দ্বন্দ্ব সবই এই নাটকগুলির মধ্যে দেখা দিল।
বৌদ্ধ ‘অবদান’ সাহিত্যের একটি উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত ‘রাজা’ নাটকে কবি ব্যক্ত করেন অজস্র মোহজাল ছিন্ন করে পরমাত্মার অনুসন্ধানে মানবাত্মার অভিসার-কাহিনি। আবার ‘ডাকঘর’-এ একই ভাবে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে মানবের অভিযাত্রার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে মিলনের মাধ্যমটি হয়েছে মৃত্যু। ‘শারদোৎসব’ ও ‘ফাল্গুনী’ নাটকদু’টি বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানবাত্মার অচ্ছেদ্য বন্ধনের স্বরূপটি নির্দেশিত হয়েছে। ‘অচলায়তন’ অনর্থক প্রথা-রীতিনীতি এবং অসার সংস্কারে আবদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের জেহাদ। এখানে কবি মুক্তমানস ও মুক্তজীবনের জয়গানে মুখর। অন্যদিকে ‘মুক্তধারা’ ও ‘রক্তকরবী’র উপজীব্য পদদলিত, লাঞ্ছিত, শৃঙ্খলিত জনতার মুক্তির সংকেতবার্তা।
নাট্যজীবনের সায়াহ্নবেলায় রবীন্দ্রনাথ মনোনিবেশ করে নৃত্যনাট্য রচনায়। এই নাটকগুলিতে নট-নটীর পরিবর্তের নর্তক-নর্তকীর ভূমিকা প্রধান। সংগীত-নৃত্য ও অভিনয়ের যুগলবন্ধী কিন্তু এগুলির নাট্যগুণ নষ্ট করেনি। ‘নটীর পূজা’ (১৯২৬) নাটকের নটীর নৃত্যে রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যের সূচনা। তাঁর নৃত্যনাট্য-ত্রয়ী ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬), ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৩৮) ও ‘শ্যামা’ (১৯৩৯) – নায়িকার জটিল হৃদয়দ্বন্দ্ব ও তৎপ্রসূত অপরাধের ভিত্তিভূমিতে দণ্ডায়মান চরিত্রগুলির মনস্তত্ত্ব তথা মানসিক বিকাশের স্তরগুলিকে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। এর বিপরীতে নৃত্যনাট্য বর্গভুক্ত ‘তাসের দেশ’ (১৯৩৩) আসলে সমকালীন ভারতের প্রেক্ষাপটে একটি রাজনৈতিক রূপকনাট্য।
রবীন্দ্রনাথ আধুনিক জীবনের সংশয়-দ্বন্দ্বের পড়ে ভারতীয় সভ্যতার বিশিষ্ট মূল্যবোধ তথা অধ্যাত্মবিশ্বাসের সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন তাঁর নাটকে। নাটকের শৈলী ও বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি সারা জীবনই পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। বিদেশি নাটকের প্রভাব থাকলেও, তাঁর নাটক তাঁর ভাঙা গানের মতোই স্বকীয়তায় ভাস্বর। সমকালীন দর্শক সমাজের স্থূলরুচি এই দুর্জ্ঞেয় নাট্য আঙ্গিককে সম্যক অনুধাবনে ও গ্রহণে অপারগ ছিল। কিন্তু এই নাট্যচিন্তার অভিশ্রুতি ঘটে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বাংলা নাট্যমঞ্চের নবনাট্য আন্দোলন ধারাটির মাধ্যমে।
নাট্যরচনা নিয়ে এই তাত্ত্বিক আলোচনার শেষ পাতে একটি রবীন্দ্র-অনাস্বাদিত নাট্যকথার প্রসঙ্গ আলোচনা করা যাক। গল্পটি শুনিয়েছেন প্রমথনাথ বিশী, তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে:
আমাদের যাত্রাপালার সাফল্য দেখিয়া রবীন্দ্রনাথে ঝোঁক হইল যাত্রা লিখিবেন। একদিন আমাকে বলিলেন, “দেখ্, এবার যাত্রাপালা লিখব ভাবছি।” আমি বলিলাম, “সাহিত্যের সব পথই তো আপনার পদচিহ্নিত; এক-আধটা গলিপথও কি আমাদের মতো আনাড়িদের জন্য রাখিবেন না?” আমার কথা শুনিয়া তিনি কী ভাবিলেন জানি না। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, যা।” ভাবটা এই, ‘ও পথটা তোদেরই ছাড়িয়া দিলাম।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাত্রাপালা লেখেননি।
0 comments