আমাদের জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’। রচয়িতা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূল রচনার ভাষা বাংলা। রচনাকাল জানা যায় না। প্রথম গাওয়া হয় ১৯১১ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এক অধিবেশনে। পাঁচ স্তবকের গানটির প্রথম স্তবকটি ১৯৫০ সালে সরকারিভাবে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি লাভ করে। একই মর্যাদা লাভ করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘বন্দে মাতরম্’ গানটিও। ‘বন্দে মাতরম্’ হয় ভারতের জাতীয় স্তোত্র বা ন্যাশানাল সং। ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ হয় জাতীয় সংগীত বা ন্যাশানাল অ্যানথেম।
মূল গানটি ইমন রাগে কাহারবা তালে নিবদ্ধ। স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বরবিতান ১৬শ খণ্ডে এর স্বরলিপি রয়েছে। ভারত সরকার অনুমোদিত জাতীয় সংগীতের স্বরলিপি মুদ্রিত হয়েছে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ‘রাষ্ট্রসংগীত’ স্বরলিপি-পুস্তিকায়।
‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ ‘গীতবিতান’-এর স্বদেশ পর্যায়ের ১৪ সংখ্যক গান। ‘সঞ্চয়িতা’-য় গানটি রয়েছে ‘ভারত-বিধাতা’ শিরোনামে। মোট পাঁচটি স্তবকের প্রথমটি জাতীয় সংগীত, সেকথা আগেই বলেছি। স্তবক পাঁচটি এই রকম:
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে
সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে –
গাহে বিহঙ্গম, পূণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে
তব চরণে নত মাথা।
জয় জয় জয় হে জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
ইতিহাস:
‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গানটির স্বরলিপি পাওয়া যায় না। তাই গানটি কবে কোথায় রচিত হয়, তাও জানা যায় না। ১৯১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে গানটি প্রথম গাওয়া হয়। গাওয়া হয়েছিল সমবেত কণ্ঠে। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে গানের মহড়া হয়েছিল ডাক্তার নীলরতন সরকারের হ্যারিসন রোডের (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড) বাসভবনে। পরদিন ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকায় গানটির ইংরেজি অনুবাদসহ এই সংবাদের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আদি ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র মাঘ ১৩১৮ অর্থাৎ জানুয়ারি ১৯১২ সংখ্যায় ‘ভারত-বিধাতা’ শিরোনামে প্রকাশিত এই গানটি ব্রহ্মসঙ্গীত আখ্যায় প্রচারিত হয়েছিল। সেই বছর ব্রাহ্মদের সবচেয়ে বড়ো উৎসব মাঘোৎসবেও গানটি গীত হয়।
রচনার ইতিহাস জানা না গেলেও গানটির অনুবাদের ইতিহাস কিন্তু জানা যায়। রবীন্দ্রনাথ গানটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন দক্ষিণ ভারতের মদনপল্লী নামে এক জায়গায়। মদনপল্লী এখন অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে। ১৯১৮-১৯ সালে এই মদনপল্লীর বেসান্ত থিওসফিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল জেমস এইচ কাজিনস রবীন্দ্রনাথকে সেখানে আমন্ত্রণ জানান। কাজিনস ছিলেন আইরিশ কবি ও রবীন্দ্রনাথের বন্ধু। জানা যায়, তাঁর অনুরোধে একটি ছাত্র সম্মেলনে গানটি বাংলায় গেয়ে শুনিয়েছিলেন কবি। পরে মদনপল্লীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবিকে গানটির ইংরেজি অনুবাদের প্রেরণা জোগায়। কাজিনসের স্ত্রী মার্গারেট ছিলেন পাশ্চাত্য সংগীতে বিশেষজ্ঞা। তিনি গানটির স্বরলিপিও করে দেন। মদনপল্লীর বেসান্ত থিওজফিক্যাল কলেজের লাইব্রেরিতে আজও সেই মূল ইংরেজি অনুবাদটি ফ্রেমবদ্ধ আকারে প্রদর্শিত হয়।
১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের সময় মস্কোয় পায়োনিয়ার্স কমিউনের অনাথ বালক-বালিকারা রবীন্দ্রনাথকে একটি গান গাইতে অনুরোধ করলে, তিনি তাদের ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গেয়ে শোনান। ১৯৩৭ সালে জাতীয় সংগীত হিসাবে প্রথম ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গানটি প্রস্তাব করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৪৩ সালের ৫ জুলাই গঠিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের। সেই দিনই প্রথম জাতীয় সংগীত হিসেবে গানটি গাওয়া হয়। ওই বছরের ২৫ অগস্ট নেতাজি আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাপতির পদ গ্রহণ করেন ও ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে আরজি হুকুমৎ-এ-হিন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। এই দিনও জাতীয় সংগীত হিসেবে জনগণমন গাওয়া হয়েছিল। নেতাজি আজাদ হিন্দ সরকারের সেক্রেটারি আনন্দমোহন সহায়ের উপর দায়িত্ব দেন গানটির হিন্দুস্থানী অনুবাদের জন্য। তিনি লয়ালপুরের তরুণ কবি হুসেনের সাহায্যে কাজটি সম্পাদন করেন। অনুবাদের সময় মূল গানের সামান্য পরিবর্তন সাধিত হলেও তার ভাব ও সুর অক্ষুন্ন থাকে। পরবর্তীকালে আনন্দমোহন সহায়ের লেখা থেকে জানা যায়, এই গান সেই সময় ভারত ও ভারতের বাইরেও বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। জাপান ও জার্মানির বিদ্বজ্জন সমাজ এই গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে আজাদ হিন্দ ফৌজ মৌডক রণক্ষেত্রে জয়লাভ করে ভারতের মাটিতে প্রবেশ করে ও সেই দিনই প্রথম ভারতের মাটিতে ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ ভারতের জাতীয় সংগীত রূপে বাজানো হয়।
ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে কোনও জাতীয় সংগীত নির্বাচিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের কাছে কোনও এক অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্য ভারতের জাতীয় সংগীতের একটি রেকর্ড চাওয়া হয়। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা তক্ষুনি ভারত সরকারকে বিষয়টি জানান ও ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে বাজানোর পক্ষে মত প্রকাশ করেন। সরকারি অনুমোদন পাওয়া গেলে জাতিসংঘের অর্কেস্ট্রাবাদনের একটি গ্রামাফোন রেকর্ড সেই অনুষ্ঠানে সাফল্যের সহিত বাজানো হয়। জওহরলাল নেহেরু পরে বলেছিলেন, এই গানের সুর সেদিন সকলে প্রশংসা করছিলেন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এই সুরটির স্বাতন্ত্র ও আভিজাত্যে মুগ্ধ হয়ে এর স্বরলিপি চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। পরে বিশেষজ্ঞেরাও বলেন, ‘গায়নযোগ্যতা’ বা ‘singability’-এর কথা মাথায় রেখে ‘বন্দেমাতরম’-এর বদলে ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’-কেই ভারতের জাতীয় সংগীত করা উচিত। অবশেষে ২৪ জানুয়ারি ১৯৫০ তারিখে ভারতের সংবিধান সভা এই গানটিকে জাতীয় সংগীত বা ন্যাশানাল অ্যানথেম হিসাবে গ্রহণ করেন। সভাপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেন, “জনগণমন নামে পরিচিত গানটি কথা সুরসহযোগে ভারতের জাতীয় সংগীতরূপে সরকারিভাবে গীত হবে। কোনও নির্দিষ্ট কারণ উপস্থিত হলে সরকার এই গানের কথায় যে কোনও রকম পরিবর্তন আনতে পারবেন। বন্দেমাতরম গানটি যেহেতু ভারতের জাতীয় সংগ্রামে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী, সেই হেতু এটিও জনগণমন-এর সমমর্যাদাসম্পন্ন হবে।”
জাতীয় সংগীত বাজানো নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু স্পষ্ট নির্দেশাবলি আছে।
(১) জাতীয় অভিবাদনের সময় – ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক প্রধান রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যগুলির সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপাল এবং বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদের (অনুষ্ঠানবিশেষে) জাতীয় অভিবাদন জানানোর সময় জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে রাজকীয় অভিবাদনের বদলে জাতীয় অভিবাদন জানানোর সময় থেকেই এই প্রথা চলে আসছে। বিদেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদের জাতীয় অভিবাদন জানানোর সময় প্রথমে সেই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয় এবং পরে ভারতের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। এখানে মনে রাখা দরকার, এই নির্দিষ্ট কয়েকজন পদাধিকারী ভিন্ন দেশে ছাড়া কারও অভিবাদন জাতীয় সংগীত দ্বারা হয় না। তবে কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় সংগীত দ্বারা অভিবাদন জানানো হয়ে থাকে।
(২) জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় – প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস ও সাধারণতন্ত্র দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনকালে জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।
(৩) অন্যান্য ব্যবহার – এছাড়াও কয়েকটি ক্ষেত্রে জাতীয় সংগীত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন, সেনাবাহিনীতে লয়্যাল টোস্ট প্রদানের সময়, নৌবাহিনীর পতাকা উত্তোলনের সময়, কুচকাওয়াজে প্রত্যয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় পতাকা আনীত হলে ইত্যাদি।
অন্যান্য সরকারি বিভাগ ও সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য। জাতীয় সংগীত ৫২ সেকেন্ডে গাওয়া হয় অথবা সংক্ষেপে গাওয়ার সময় ২০ সেকেন্ডে এর প্রথম ও শেষ পংক্তি গাওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এক মিনিটের বেশি সময় নিয়ে এই গান গাওয়া যায় না। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় উঠে দাঁড়ানো কর্তব্য। আগে সিনেমা হলে সিনেমা শেষ হওয়ার পর জাতীয় সংগীত বাজানোর প্রথা ছিল। এখন আর এই প্রথা নেই।
আমাদের জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্কও কম নেই। আসলে গানটি লেখা হয়েছিল ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লি দরবারের কিছুদিন আগে। এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিল সেই বছরের ২৭ ডিসেম্বর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে। সেই দিনের এজেন্ডা ছিল রাজা পঞ্চম জর্জকে একটু আনুগত্যমূলক স্বাগত জানানোর প্রস্তাবনা। রাজার সম্মানে সেদিন হিন্দিতে রামভূজ চৌধুরীর একটি গান গাওয়া হয়। আবার সেই দিনই রবীন্দ্রনাথের মত এক বিশিষ্ট ব্যক্তির গান অনুষ্ঠানে গীত হওয়ায় সংবাদমাধ্যমের ভুলে একটি ভ্রান্ত খবর প্রচারিত হয় যে রবীন্দ্রনাথের গানটিও সম্রাটের প্রতি সম্মানার্থে রচিত হয়েছে। পরদিনের ইংরেজি সংবাদপত্রগুলিতে এই সংবাদ প্রচারিতও হয়ঃ “বাঙালি কবি বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশেষত সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে একটি গান রচনা করেছেন।” স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্র-বিরোধীরা প্রচার করতে থাকেন যে গানটি আসলে সম্রাটের বন্দনাগান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সংবাদপত্রগুলির একটি কয়েকটি ‘বন্দেমাতরম’ রবীন্দ্রনাথের রচিত ও ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’-কে হিন্দি গান আখ্যাও দিয়েছিল। প্রকৃত ঘটনা জানা যায় ১৯৩৭ সালের ২০ নভেম্বর বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী পুলিনবিহারী সেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকেঃ
“ “…সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনও বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমন-অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি, পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ কোনো জর্জই কোনক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন।…”
আবার গানের ‘সিন্ধু’ শব্দটিকে পরিবর্তিত করে ‘কাশ্মীর’ শব্দটি যোজনা করার দাবি ওঠে ২০০৫ সালে। যাঁরা দাবি তুলেছিলেন, তাঁদের যুক্তি ছিল, ১৯৪৭ সালের ভারত-বিভাগের পর সিন্ধু প্রদেশের পুরোটাই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই দাবির বিরোধীরা পাল্টা যুক্তি দেন, জাতীয় সংগীতে ‘সিন্ধু’ শব্দটি কেবলমাত্র সিন্ধু প্রদেশ নয়, বরং সিন্ধু নদ ও ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ সিন্ধি ভাষা ও সংস্কৃতিরও পরিচায়ক। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই যুক্তি মেনে জাতীয় সঙ্গীতের ভাষায় কোনরূপ পরিবর্তনের বিপক্ষে মত দেন।
১৯৮৫ সালে কেরল রাজ্যের জিহোবাস উইটনেস-এর কয়েকজন ছাত্র বিদ্যালয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে অস্বীকার করলে, তাদের স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হয়। একজন অভিভাবক সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে, সুপ্রিম কোর্ট কেরল হাইকোর্টের রায় বদলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ছাত্রদের পুনরায় ভরতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। সুপ্রিম কোর্টের সেই ঐতিহাসিক রায়ে বলা হয়েছিল, “আমাদের (ভারতীয়) ঐতিহ্য শেখায় সহিষ্ণুতা, আমাদের দর্শন শেখায় সহিষ্ণুতা, আমাদের সংবিধান শেখায় সহিষ্ণুতা, তাকে আমরা যেন নষ্ট করে না ফেলি।”
আমাদের জাতীয় সংগীত সম্পর্কে বিশিষ্টদের মতামত
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (আরজি হুকুমৎ-এ-হিন্দ-এর নির্দেশনামা)
“ রবীন্দ্রনাথের গান জয়-হে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হল। ”
আনন্দমোহন সহায়, সেক্রেটারি, আরজি হুকুমৎ-এ-হিন্দ
“ অনেক উচ্চশিক্ষিত জাপানি স্বীকার করেন যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত মানুষকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে তাঁদের জাতীয় সংগীতকেও পিছনে ফেলে দেয়। বিভিন্ন সময়ে জনসমক্ষেই তাঁরা একথা বলেছেন। নেতাজি আমাকে বলেছিলেন, জার্মানরা, যারা তাদের নিজেদের জাতীয় সংগীতকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতীয় সঙ্গীত মনে করত, তারাও বেশি কিছু না হলেও, তাঁর কাছে মুক্তকণ্ঠেই স্বীকার করেছিল যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত তাদেরটির মতোই উদ্দীপক। ”
জেমস এইচ কাজিনস
“ আমার প্রস্তাব হল, ডক্টর রবীন্দ্রনাথের গভীর দেশাত্মবোধক, আদর্শ প্রণোদিত এবং একই সঙ্গে বিশ্বাত্মবোধক মর্নিং সং অব ইন্ডিয়া (জনগণমন), যা বিগত কুড়ি বছর বেসরকারিভাবে ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, তাকেই সরকারিভাবে অনুমোদন করা হোক। ”
মহাত্মা গান্ধী
“ জনগণমন শুধু একটি গানমাত্র নয়, এটি একটি “দিব্য স্তোত্র”। এটি চরিত্রে স্বতন্ত্রভাবেই জাতীয়। এর “গায়নযোগ্যতা”-ও আছে। ”
জওহরলাল নেহেরু
“ …১৫ অগস্ট ১৯৪৭-এর অনতিকাল পরেই অর্কেস্ট্রা ও ব্যান্ডে বাজানোর উপযোগী জাতীয় সঙ্গীতের একটি সুর থাকা আমাদের কাছে এক অত্যন্ত জরুরি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের প্রতিরক্ষা বিভাগ, বৈদেশিক দৌত্য ও প্রতিনিধিত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চিতভাবেই স্বাধীনতার পরে গড সেভ দ্য কিং আর আমাদের সেনাবাহিনীতে বাজানোর উপযুক্ত ছিল না। বারংবার বাজানোর জন্য একটি সুর আমাদের থেকে চাওয়া হতে থাকে। কিন্তু আমরা তার কোনও সদুত্তরই দিতে পারি না, কারণ এই সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী একমাত্র সংবিধান সভা।
“কিঞ্চিত পরিবর্তনের সহিত জনগণমন-এর সুর দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজ কর্তৃক জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয়েছিল এবং সেই সঙ্গে ভারতেও তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
“নিউ ইয়র্কে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভার এক অনুষ্ঠানে সমক্ষে আসে। কোনও একটি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্য আমাদের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে আমাদের জাতীয় সংগীতটি চাওয়া হয়। প্রতিনিধিরা জনগণমন রেকর্ড করে অর্কেস্ট্রার অনুশীলনের জন্য সেটি প্রদান করে। তাঁরা যখন এটি এক বৃহৎ সম্মেলনে বাজান, তখন এই গানটি অত্যন্ত প্রশংসিত হয় এবং অনেক দেশের প্রতিনিধিরা এই নতুন সুরের স্বাতন্ত্র ও আভিজাত্যে মুগ্ধ হয়ে এর স্বরলিপিটি চাইতে থাকেন। জনগণমন-এর সেই অর্কেস্ট্রাবাদনটি রেকর্ড করে ভারতে পাঠানো হয়। আমাদের প্রতিরক্ষা বিভাগের ব্যান্ডগুলি এই সুরটিই বাজাতে থাকে এবং বৈদেশিক দূতাবাস ও প্রতিনিধিমহল প্রয়োজন অনুসারে এটিই ব্যবহার করতে থাকেন। অনেক দেশ থেকেই আমাদের এই সুরের জন্য প্রশংসাবার্তা ও অভিনন্দনপত্র আসতে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলতে থাকেন, তাঁদের শোনা অন্যান্য দেশের জাতীয় সঙ্গীতের সুরের চেয়ে এই সুর শ্রেষ্ঠতর। দেশে-বিদেশে বিশেষজ্ঞ সংগীতবিদ, ব্যান্ড ও অর্কেস্ট্রাগুলি এই সুর বাজাতে থাকেন। কোনও কোনও সময় সুরের সামান্য পরিবর্তন হয়ে যায়। যে জন্য অল ইন্ডিয়া রেডিও এই গানের অনেকগুলি রূপান্তরণ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে।
সুরের জন্য এই সাধারণ প্রশংসা ছাড়াও বলতে হয়, আমাদের কাছে সে-সময় নির্বাচনের জন্য কোনও যথাযথ জাতীয় গানের সংগীতায়োজন ছিল না, যা আমরা বিদেশে পাঠাতে পারতাম। সেই অবস্থায় আমি সকল প্রাদেশিক গভর্নরদের চিঠি দিই এবং জনগণমন বা অন্য কোনও গান জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের মতামত জানতে চাই। আমি তাঁদের বলি যে উত্তর দেওয়ার আগে যেন তাঁরা তাঁদের প্রধানমন্ত্রীদের (প্রিমিয়ার) সঙ্গেও কথা বলে নেন। আমি তাঁদের স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছিলাম যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী একমাত্র সংবিধান সভা। কিন্তু বৈদেশিক দূতাবাস ও প্রতিরক্ষা বিভাগে নির্দেশ পাঠানোর জরুরি কারণে সাময়িক এক সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। একজন বাদে (সেন্ট্রাল প্রভিন্স বা মধ্য প্রদেশের গভর্নর) সকলেই জনগণমন-এর পক্ষে সাক্ষর করেন। এই কারণে ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যতদিন না সংবিধান সভা কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে, ততদিন সাময়িকভাবে জনগণমন ব্যবহৃত হবে।
“প্রাদেশিক গভর্নরদের সেই মতো নির্দেশ দেওয়া হয়। স্পষ্ট হয়ে যায় জনগণমন-এর বিন্যাস সম্পূর্ণ যথাযথ ছিল না, কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। শুধু শব্দবিন্যাসটিই নয়, সবচেয়ে ছিল জরুরি ছিল সুরটিও – যেন সেটি অর্কেস্ট্রা ও ব্যান্ডে বাজানো যেতে পারে।”
[ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]
0 comments