সংবিধান দেশের মৌলিক আইন। দেশের সরকারের মূলনীতিগুলি প্রতিফলিত হয় সংবিধানে। সংবিধান শুধু সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের গঠন ও কাজকর্মের রূপরেখাই ঠিক করে না, বরং সরকারের সঙ্গে দেশের আমজনতার সম্পর্ক কেমন হবে তাও বলে দেয়। ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরই লিখিত সংবিধান রয়েছে।
স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ স্থাপন করা হয়েছিল। এই গণপরিষদই ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতা ও প্রবর্তক। ঔপনিবেশিক যুগের বিভিন্ন আইন ও সনদ এই সংবিধানের উপরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। তাই বর্তমান ভারতের সংবিধান রচনার ইতিহাস আলোচনার আগেই সেই পুরনো সনদ ও আইনগুলির ইতিহাসও জেনে নেওয়া জরুরি।
সংবিধান রচনার পটভূমি
১৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্রিটিশরা ভারতে আসে প্রথম বণিকের বেশে। বাণিজ্যের সুবিধার জন্য তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি সংস্থা চালু করেছিল। কোম্পানি রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে ‘ইস্ট ইন্ডিজ’ অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করার অধিকার-সনদ লাভ করে। প্রথম দিকে সনদের মেয়াদ ছিল পনেরো বছর। বলা হয়েছিল, সরকার বা ব্রিটিশ জনগণের কোনো ক্ষতি না হলে, সনদের মেয়াদ বাড়ানো হবে। সনদ পাওয়ার পর কোম্পানি স্থানীয় শাসকদের কাছ থেকে জমি ও নানা সুযোগসুবিধা আদায় করে বাণিজ্য কুঠি ও বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে। কোম্পানি পরিচালনার জন্য তাকে আইন, সংবিধান, আদেশ (অর্ডার) ও অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) জারি করার অধিকারও দেওয়া হয়েছিল। ১৬০৯ ও ১৬৬১ সালের সনদের পুনর্নবীকরণ করার পর কোম্পানির ইজারার মেয়াদ বর্ধিত হয়।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কোম্পানির ধ্যানজ্ঞান ছিল মূলত বাণিজ্যই। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে ভারতে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়, তার পূর্ণ সদব্যবহার করে কোম্পানি ভারতের প্রভু হয়ে বসে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের কোম্পানির জয়লাভ ভারতে কোম্পানির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি আদায় করে নেয়। এর ফলে কোম্পানি রাজস্ব আদায় ও বিচারবিভাগীয় কাজকর্ম পরিচালনার দায়িত্ব পায়। ভারতের মাটিতে স্থাপিত হয় কোম্পানির সার্বভৌমত্ব।
ইতিমধ্যে কোম্পানির কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ সরকার একাধিক সনদ ও আইন পাস করে। এগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আইন হল: ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং আইন, ১৭৮১ সালের সংশোধনী আইন, ১৭৮৪ সালের পিটের ভারত আইন, ১৭৮৬ সালের আইন এবং ১৭৯৩, ১৮১৩, ১৮৩৩ ও ১৮৫৩ সালের সনদ আইন। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে কোম্পানির শাসনব্যবস্থা অবলুপ্ত হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৮ সালের ভারত সরকার আইন অনুযায়ী ভারতের শাসনভার স্বহস্তে তুলে নেয়।
১৮৫৮ সালের পর ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন করার জন্য একাধিক আইন পাস করেছিল। ব্রিটিশ সরকারের পাস করা আইনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ১৮৬১, ১৮৯২ ও ১৯০৯ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন এবং ১৯১৯ সালের ভারত সরকার আইন। তবে এগুলির বেশিরভাগই ভারতীয়দের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রশাসনিক কাজকর্মে ভারতীয়দের বৃহত্তর অংশগ্রহণের সুযোগ আদায়ের দাবিতে আন্দোলনও তীব্র হতে থাকে। ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্য ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন আমাদের জাতীয় নেতৃবর্গ।
১৯৩৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দাবি করে, কোনো রকম বিদেশি হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারতীয়দের নিজেদের সংবিধান রচনার অধিকার দিতে হবে। জওহরলাল নেহেরু প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি গণপরিষদ গঠনের দাবি জানান। ব্রিটিশ সরকার অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়া আগে পর্যন্ত এই দাবিতে কর্ণপাত করেনি। ১৯৪০ সালে পরিস্থিতির চাপে পড়ে ব্রিটিশরা স্বশাসিত ভারতের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনার অধিকার ভারতীয়দের দিতে রাজি হয়। ১৯৪২ সালে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস কিছু প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধের সময় যেনতেনপ্রকারেণ ভারতের সহযোগিতা বজায় রাখা। কিন্তু তাঁর প্রস্তাব কংগ্রেস বা মুসলিম লিগ কারোর পক্ষেই মানা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৪ (সি আর ফরমুলা) ও ১৯৪৫ (ওয়াভেল পরিকল্পনা) সালে সাংবিধানিক জটিলতা কাটানোর চেষ্টা করা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। পরে ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের দৌলতে সমস্যার সমাধান হয়। উক্ত প্ল্যানে সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ স্থাপনের কথা বলা হয়। আর যতদিন না সংবিধান রচিত হয়, ততদিন ভারতের সব প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথাও বলা হয়।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয় ভারতীয় স্বাধীনতা আইন। এই আইন বলে ব্রিটিশ ভারত ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান অধিরাজ্য (ডোমিনিয়ন) স্থাপিত হয়। উক্ত অধিরাজ্য দুটির আইনসভাকে যেকোনো আইন পাসের অধিকার দেওয়া হয়।
১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ অগস্ট মধ্যরাতে গণপরিষদের একটি বিশেষ অধিবেশনে ভারতের শাসনক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর গণপরিষদ সংবিধান ও আইন-প্রণেতার যৌথ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। এইভাবে গণপরিষদই হয়ে ওঠে ভারতের প্রথম সংসদ। ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনের এই কাজ চালিয়ে যায় গণপরিষদ।
সংবিধান রচনার ইতিহাস
আগেই বলেছি, ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের অধীনে ভারতের গণপরিষদ স্থাপিত হয়। গণপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৮৯ (প্রদেশগুলির ২৯২ জন, দেশীয় রাজ্যগুলির ৯৩ জন, চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশগুলির ৩ জন ও বালুচিস্তানের ১ জন)। ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। অন্তর্বর্তী সভাপতি নির্বাচিত হন গণপরিষদের প্রবীণতম সদস্য ড. সচ্চিদানন্দ সিনহা। ভারত বিভাগের পর মুসলিম লিগ তাদের সদস্যদের প্রত্যাহার করে নিলে গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা কমে হয় ২৯৯ (প্রদেশগুলির ১২৯ জন ও দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে ৭০ জন)। গণপরিষদ সংবিধান রচনার জন্য ১৩টি কমিটি গঠন করে। এই কমিটিগুলির রিপোর্ট অনুসারে, ড. ভীমরাও রামজি আম্বেডকরের নেতৃত্বে একটি সাত সদস্যের খসড়া কমিটি সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করে।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে খসড়াটি প্রকাশিত হয় এবং দেশবাসীকে খসড়াটি নিয়ে আলোচনা ও সংশোধনী প্রস্তাবের জন্য আট মাস সময় দেওয়া হয়। ৭৬৩৫টি সংশোধনী প্রস্তাব আসে, যার মধ্যে ২৪৭৩টি আলোচনার পর বাতিল হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত গণপরিষদের মোট এগারোটি অধিবেশন বসে। সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী দেশবাসী, গণমাধ্যম, প্রাদেশিক আইনসভা ও গণপরিষদ কর্তৃক আলোচিত ও সংশোধিত হওয়ার পর ১৯৪৯ সালের ২৬ জানুয়ারি খসড়াটিতে সই করেন গণপরিষদের সভাপতি। গণপরিষদের অন্যান্য সদস্যরা খসড়াটিতে সই করেন ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি। সংবিধান কার্যকর করা হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। তবে নাগরিকত্ব, নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সংসদ ও সাময়িক ও হস্তান্তরযোগ্য বিষয়গুলি ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বরই কার্যকর হয়ে যায়। এইভাবে ২ বছর, ১১ মাস, ১৮ দিনের প্রচেষ্টায় রচিত হয় ভারতের সংবিধান।
[ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]
0 comments