বন্দে বাঞ্ছিতলাভায় চন্দ্রার্ধ্বকৃতশেখরাম্। বৃষারূঢ়াং শূলধরাং শৈলপুত্রীং যশস্বিনীম্।।
আশ্বিন মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে (সর্বপিতৃ অমাবস্যা বা মহালয়ার পরদিন) দেবী শৈলপুত্রীর পূজার মাধ্যমে শুরু হয় নবরাত্রি উৎসব। ‘শৈলপুত্রী’ নামের অর্থ ‘পর্বতের কন্যা’; সেই অর্থে ‘পার্বতী’ ও ‘শৈলপুত্রী’ সমার্থক। ইনিই দেবীকবচোক্ত নবদুর্গার প্রথম রূপ।
দেবী শৈলপুত্রী দ্বিভুজা–তাঁর এক হাতে পদ্ম, অপর হাতে ত্রিশূল। দেবীর মস্তকে অর্ধ্বচন্দ্র; বাহন বৃষ; ভৈরব শৈলেশ্বর।
শৈলপুত্রী সম্পর্কে যে পৌরাণিক কাহিনিটি প্রচলিত, সেটি সতীর দেহত্যাগ ও হিমালয়ের গৃহে দুর্গার জন্মগ্রহণের বৃত্তান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। এই কাহিনিটি আমাদের সকলেরই জানা–সতীর পিতা দক্ষ এক শিবহীন যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। এই যজ্ঞে বিনানিমন্ত্রণে উপস্থিত হওয়ায় পিতৃমুখে সতীকে শুনতে হল শিবনিন্দা। তৎক্ষণাৎ যজ্ঞস্থলেই দেহত্যাগ করলেন শিবপ্রিয়া সতী। শিব ও তাঁর অনুচরবৃন্দ দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করলেন। তারপর সতীবিরহে কাতর শিব বসলেন ধ্যানে। এদিকে তারকাসুরের অত্যাচারে দেবতারা অস্থির হয়ে উঠলেন। তারকাসুর বর পেয়েছিল, শিবের পুত্র ভিন্ন কারো হাতে সে মরবে না। কিন্তু শিব বসেছেন ধ্যানে, সতী করেছেন দেহত্যাগ। শিব-দুর্গার পুত্র এখন আসবে কোত্থেকে? দেবতারা কাতর হয়ে মহামায়া দুর্গার নিকট প্রার্থনা জানাতে লাগলেন পরিত্রাণের জন্য। এদিকে গিরিরাজ হিমালয় ও তাঁর পত্নী মেনকা অনেক দিন ধরে দুর্গাকে কন্যারূপে লাভ করার জন্য করছিলেন তপস্যা। তাঁদের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে সতী দেবতাদের পরিত্রাণের জন্য হিমালয়ের গৃহেই পুনর্জন্ম গ্রহণ করলেন। শৈলরাজের পুত্রীরূপে মহামায়া দুর্গা হলেন শৈলপুত্রী। সতীর অপর নাম ‘হৈমবতী’–হিমবৎ (হিমালয়) পর্বতের কন্যা।
হৈমবতী নামটি আমরা সামবেদীয় কেন উপনিষদ্-এও পাই:
স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়মাজগাম বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীং তাং হোবাচ কিমেতদ্ যক্ষমিতি।। (কেন, ২৫)
(তিনি [ইন্দ্র] সেই আকাশেই স্ত্রীরূপিণী পরমারূপবতী হৈমবতীকে [আবির্ভূত হতে দেখে তাঁর] নিকটে গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই পূজনীয় স্বরূপ কে?’)
গল্পটির সারমর্ম এই: একবার দেব ও অসুরের যুদ্ধে ব্রহ্ম দেবতাদের জয়ী করেছিলেন। কিন্তু ব্রহ্মের শক্তিকে ভুলে দেবতারা জয়ের গৌরব নিজেরাই নিতে উদ্যত হলেন। ব্রহ্ম তখন নিজে এলেন দেবতাদের দর্পচূর্ণ করতে। তিনি একখণ্ড তৃণ রাখলেন দেবতাদের সম্মুখে। কিন্তু দেবতারা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, অগ্নি সেই তৃণখণ্ডটি দহন করতে বা বায়ু তা একচুল পরিমাণ স্থানান্তরিত করতে অসমর্থ হলেন। তখন ইন্দ্র এলেন সেই জ্যোতির্ময় ব্রহ্মকে জানতে। ব্রহ্ম অন্তর্হিত হলেন। ব্রহ্মশক্তি হৈমবতী রূপে ইন্দ্রের সামনে উপস্থিত হয়ে ব্রহ্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করলেন।
তবে, মনে হয়, ঔপনিষদ হৈমবতী ও পৌরাণিক শৈলপুত্রী দুই পৃথক দেবী। ‘হৈম’ শব্দের অপর অর্থ হিরণ্ময় বা সোনার মতো উজ্জ্বল। সম্ভবত ব্রহ্মশক্তির জ্যোতির্ময়ী রূপটির কথা স্মরণ করেই উপনিষদে ‘হৈমবতী’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে; এর সঙ্গে হিমবৎ পর্বতের কোনো সম্পর্ক নেই। উপরন্তু তন্ত্রে দেবতাদের দর্পচূর্ণকারী উমা হৈমবতীর রূপটি একালের বাংলায় কার্তিক শুক্লানবমীতে পূজিতা জগদ্ধাত্রীর অনুরূপ।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, কালিকাপুরাণ-এ উল্লিখিত চৌষট্টি যোগিনীর অন্যতমা হলেন শৈলপুত্রী।
দেবী শৈলপুত্রীর মন্দির রয়েছে কাশীর (বারাণসী) আলাইপুরার মড়িঘাটের কাছে। বর্তমান মন্দিরটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসস্তুপের উপর নির্মিত। তবে মন্দির চত্বরের প্রাচীন কুয়োটি এখনও আছে। মূল মন্দিরটি ছোটো। এই মন্দিরের গর্ভগৃহের পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে শৈলপুত্রীর কষ্টিপাথরের মূর্তিটি। সামনে কুণ্ডের মধ্যে কাশীখণ্ডস্থিত প্রাচীন শিবলিঙ্গ শৈলশ্বর। দেবীমূর্তি ও শিবলিঙ্গ উভয়েরই উচ্চতা এক হাত। শারদীয়া ও বাসন্তী নবরাত্রির প্রথম দিনে এই মন্দিরে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। এই দিনটিই সাধকদের নবদুর্গা-আরাধনার প্রথম দিন; সাধকের মন এই দিনে মূলাধার চক্রে অবস্থান করে।
[ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]
0 comments